লাফিয়ে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য

সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এই আতঙ্কে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুতের হিড়িক পড়েছে। পুরো মাসের বাজার একসঙ্গে কেনার চেষ্টা করছে অনেকেই। বাজারে নিত্যপণ্যের চাহিদা বেশি হওয়ায় এ সুযোগে দাম বাড়িয়েছে একদল অসাধু ব্যবসায়ী। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে তারা প্রতিটি পণ্যেরদাম বাড়িয়েছে দ্বিগুন-তিনগুন। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম।

রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব জেলাতেই বাজারে তিন দিন আগেও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিছুটা স্বাভাবিক দরে বিক্রি হয়েছে। এখন বাজারে ডাল, তেল, রসুন, মরিচ, আলুসহ বেশিরভাগ জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা।

অন্যদিকে, সব ধরনের সেদ্ধ চালের দাম কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। আর পিয়াজের দামও বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত।

রাজধানীর কাওরান বাজার, সেগুন বাগিচা, রামপুরা বাজার, যশোরের বড় বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা যায়।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। তাই আতঙ্কিত হয়ে প্রয়োজনের অধিক পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন মন্ত্রী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই মন্ত্রীর বক্তব্য তেমন প্রভাব রাখেনি বাজারে বা ক্রেতাদের ওপরে। হঠাৎ এভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়া কিংবা ভোক্তাদের বাড়তি কেনার প্রবণতা কোনোটিই যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন তারা।
প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে সব দোকানের চার্টে দাম নির্ধারণের নির্দেশ দিলেও সাধারণ মানুষের অভিযোগ, প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার এমনটি হচ্ছে।

পিয়াজের দাম দ্বিগুণ: করোনা আতঙ্কে আবার অস্থির হয়ে উঠেছে পিয়াজের বাজার। দুই দিনের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে পিয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। খুচরা বাজারে গত দুই দিন আগেও ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া দেশি পিয়াজের দাম এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকা। কোথাও ৭০ টাকা বিক্রি হলেও আবার কোথাও ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পিয়াজ ব্যবসায়ী জুয়েল বলেন, করোনা আতঙ্কে গত বুধবার থেকে পিয়াজ, রসুন, আদা, আলুর চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদা বাড়ায় আড়ৎ থেকে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আড়তে দাম বাড়ার কারণে আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। মানুষ যদি কম পরিমাণে এসব পণ্য ক্রয় করে তাহলে আমাদের ধারণা কিছুদিনের মধ্যেই আবার দাম কমে যাবে।

বাজারে দেশি রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়, যা দুইদিন আগে ছিল ৭০-৮০ টাকা। আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৯০ টাকা, যা বুধবার ছিলো ১৪০-১৫০ টাকা। ১০০-১২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া আদার দাম বেড়ে হয়েছে ১৭০-১৮০ টাকা। আর ১৮-২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া গোল আলু বিক্রি হচ্ছে ২৫-২৮ টাকা।

কাওরান বাজারে আসা আসিফ বলেন, আতঙ্কে এখন সবাই পিয়াজ, রসুন, আদা, আলু মজুদ করতে শুরু করেছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যাদের বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকার কথা তাদের কেউ দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

আরেক ক্রেতা বলেন, এখন পিয়াজের ভরা মৌসুম। সেই হিসেবে দাম কমার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অনেকেই বেশি করে পিয়াজ কিনে রাখায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দায়িত্বশীলরা দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বাজারে সব পণ্যের দাম অস্থির হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা অনেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

এদিকে, আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। কেজিতে ৩ টাকা কোনোটা ৫ টাকা আবার কোনোটা ৭ টাকা বেড়েছে। ৫৩ টাকায় বিক্রি হওয়া মিনিকেট চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়। এদিকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হওয়া ২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকায়। পাইজাম ৫ টাকা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়।

চাল বিক্রেতা আলম বলেন, অন্য সময়ের চেয়ে বস্তায় চালের দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এখন আমাদের বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে বলে জানান এই বিক্রেতা।

কাওরানবাজার কিচেন মার্কেটের মায়ের দোয়া স্টোরের কর্মচারী বাবলু বলেন, কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা করে বেড়েছে চালের দাম। মিনিকেট এখন ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

কাওরান বাজারের একাধিক চালের আড়তে দেখা গেছে, মিনিকেট প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ২৬০০ টাকা, আটাশ বিক্রি হচ্ছে ২১০০ টাকা ও মানভেদে নাজির ২৩০০ থেকে ৩১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মেসার্স হাজী ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের মালিক জসিম উদ্দিন বলেন, বস্তায় চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। গত দুই দিন খুব বিক্রি ছিলো। আজ কিছুটা কম। তবে অন্য সময়ের চেয়ে বিক্রি তুলনামূলকভাবে বেশি।
গার্মেন্ট কর্মী মিতু বলেন, গত সপ্তাহে যে চাল কিনেছিলাম ৪০ টাকা কেজি। এখন তার দাম চাচ্ছে ৪৮ টাকা। যাদের টাকা আছে তারা বেশি করে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো এতো টাকা নেই যে আমরা বেশি করে কিনে রাখবো।

এদিকে কাঁচা সবজির দাম এখনো অনেকটাই স্বাভাবিক রয়েছে। সবজির দাম বাড়ার তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি বরং কিছু কিছু সবজির দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কমেছে। গত সপ্তাহে ১২০-১৩০ কেজি বিক্রি হওয়া করলার দাম কমে ৪০-৫০ টাকা হয়েছে। মাঝারি আকারের লাউ আগের মত বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা পিস। বরবটির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিলো ৮০-১০০ টাকা। এছাড়া শসা ২০-৩০ টাকা, পেঁপে ৩০-৪০ টাকা, পাকা টমেটো ২০-৪০ টাকা, শিম ৪০-৫০ টাকা, ফুলকপি-বাঁধাকপি পিস ৩০-৩৫ টাকা, গাজর ২০-৩০ টাকা, শালগম ২৫-৩০ টাকা, মুলা ১৫-২০ টাকা, বেগুন ৩০৪০ টাকা ও পটল ৪০-৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে এসব সবজির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আর কাঁচা মরিচের পোয়া (২৫০ গ্রাম) আগের মতোই ১৫-২৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

সবজি ব্যবসায়ী মিলন বলেন, কাঁচা সবজি কিনে মজুদ করে রাখা যায় না এ কারণে যার যতটুকু প্রয়োজন সে ততটুকু কিনছে। তাই সবজির দাম বাড়েনি। পিয়াজ, আদা, রসুনের মত সবজি মজুদ করা গেলে ঠিকই দাম বাড়তো।

বেশিরভাগ সবজির মতো মাছ ও মাংসের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বিভিন্ন মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০-৫০০ টাকা। নলা (ছোট রুই) মাছ ১৬০-১৮০ টাকা, তেলাপিয়া ১৩০-১৭০ টাকা, পাঙাশ ১৪০-১৮০ টাকা, শিং ৩০০-৪৫০ টাকা, শোল মাছ ৪০০-৭৫০ টাকা, পাবদা ৪৫০-৬০০ টাকা, বোয়াল ৫০০-৮০০ টাকা এবং টেংরা ৪৫০-৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

বয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ১২৫-১৩০ টাকা কেজি। তবে পাকিস্তানি কক মুরগির কেজি আগের মত বিক্রি হচ্ছে ২৩০-২৪০ টাকায়। লাল লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা কেজি। গরুর মাংস ৫৫০-৫৭০ টাকা এবং খাসির মাংস ৭০০-৮৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে, কিছুটা বেড়েছে গরুর মাংসের দাম। ৫৩০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হওযা গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে এখন ৫৭০ থেকে ৫৮০ টাকায়। আবার কোথাও কোথাও ৬০০ টাকা বিক্রি করতে দেখা যায়।

এদিকে, করোনা ভাইরাস ঘিরে আতঙ্ক থেকে চাহিদার অতিরিক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখতে ক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করেছেন সুপারমার্কেটগুলোর মালিকরা। তারা বলছেন, সুপারমার্কেটগুলোতে পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। অতিরিক্ত পণ্য কেনার প্রয়োজন নেই। এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশে সুপারমার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশেন।

গণ্যমাধ্যম কর্মী গোলাম সামদানি ফেসবুক স্টাটাসে লিখেছেন, বৃহস্পতিবার রাতে মতিঝিল কলোনি কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখলাম, বাজারে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। মানুষ দোকানে লাইন দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য কিনছেন।

দোকানদাররা ক্রেতার ভিড়ে তাদের পণ্য বিক্রি করে কুলাতে পারছেন না। তবে কোন নিয়মনীতি নেই। যে দোকানদার যেভাবে পারছেন ক্রেতাদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো দাম রাখছেন। একই পণ্য পাশাপাশি দোকানের মধ্যে কেজি প্রতি ২০/৩০ টাকা বেশি ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে। তবে দেখলাম ক্রেতারা আমার মতো একাধিক দোকান যাচাই বাছাই করছেন না। যে ক্রেতা, যে দোকানে গেছেন, তিনি সে দোকানদারের বেঁধে দেয়া দামেই ভদ্রলোকের মতো কিনে ফেলছেন। ভাবটা এমন দামাদামি করা অভদ্রতা। মনের খুশিতে তারা প্রয়োজনের অনেক বেশি জিনিস ক্রয় করছেন। এক লোক দেখলাম ৩৬০টি ডিম কিনলো! দেখার কেউ নেই! উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ।

পণ্যের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণে হটলাইন চালু: পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে চালু হয়েছে হটলাইন। এখন থেকে ১৬১২১ হটলাইন নম্বরে সপ্তাহের সাতদিন ২৪ ঘণ্টা এ সেবা চালু থাকবে। যেখানে কোনো ভোক্তা পণ্য বা সেবা কিনে প্রতারিত হলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করতে পারবেন। এর প্রেক্ষিতে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।