চার কারণেই সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিবের পদ হারালেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া সরকারের সবাই দুর্নীতিবাজ এমন বক্তব্য দেয়া, রংপুরে সাদ এরশাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান নেয়া, নিজ দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকা, বেগম রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের সঙ্গে সাংগঠনিক সমন্বয়হীনতার কারণেই মহাসচিবের পদ হারিয়েছেন তিনি। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা এসব তথ্য জানান।
নেতারা মনে করেন করোনা পরিস্থিতি ও বন্যায় বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব হিসেবে রাঙ্গার ভূমিকা থাকার কথা ছিল তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করেন দলের চেয়ারম্যান ও শীর্ষ নেতারা। এটিও একটি কারণ হতে পারে। দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এ তথ্য জানান।
গত ১৪ জুলাই দুপুরে রংপুরের পল্লী নিবাসে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এখন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেষ্টা করলেও দুর্নীতিবাজদের কারণে সরকারের অনেক প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে না। শুধু স্বাস্থ্য খাত নয়, সব খাত দুর্নীতিবাজদের দখলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকে এ প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, রাঙ্গা মারাত্মক ভুল করেছেন সরকারের বিরুদ্ধে কঠিন বক্তব্য দিয়ে। যে বক্তব্য দলের জন্য খুবই ক্ষতিকর হয়েছে। গত দুই সপ্তাহ থেকে তাকে সরানোর জন্য সরকার থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে।
গত ৫ জুন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রংপুরের পল্লীনিবাসে তার ছেলে স্থানীয় এমপি রাহগীর আল মাহে সাদ এরশাদ ও তার স্ত্রীর ওপর হামলা হয়। হামলার পর সাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ জাপার শীর্ষ নেতারা। তারপর থেকে সাদ এরশাদও রাঙ্গার বিরুদ্ধে সরকারের নীতি-নীর্ধারণী পর্যায়ের কাছে নালিশ প্রদান করেন।
আবার কেউ মনে করছেন চেয়ারম্যানের সঙ্গে মহাসচিবের অনেকদিন ধরেই মতবিরোধ চলছিল। পার্টির কোনো কিছুতেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতেন না মহাসচিব। আবার কেউ কেউ মনে করছেন একটি বিশেষ মহলকে খুশি করতে জিএম কাদের মহাসচিবকে সরিয়ে দিয়েছেন।
আরেক পক্ষ মনে করেন রংপুরে জাতীয় পার্টির দু-তিনটি ধারা বিদ্যমান। এর মধ্যে রসিক মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা হচ্ছেন জিএম কাদেরের আস্থাভাজন। এই গ্রুপটিও রাঙ্গার ওপর নাখোশ। সম্প্রতি জাপায় ফেরা ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারের সঙ্গে রাঙ্গা দা-কুমড়া সম্পর্ক। কারণ যাই হোক খুশি-নাখোশ দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া রয়েছে দলটিতে। তবে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে বিকল্প এবং যোগ্য বলে মানতে চাইছেন না অনেকেই। তারা মনে করছেন এর আগে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু মহাসচিব ছিলেন। তখন তার সাংগঠনিক দক্ষতা জানা আছে। একমাত্র এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে দিলে পার্টি চাঙ্গা হতো। এখন যা হয়েছে এতে পার্টির খুব একটা লাভ হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শীর্ষনেতা জানিয়েছেন, জিএম কাদেরের জন্য এই নজির সুখকর হলো না। নেতাকর্মীরা তার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে। অনেকে ভেবেছিলেন জিএম কাদের ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। যা তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে জানান দিয়েছেন।
তিনি বলেছিলেন, আমি হঠাৎ করে কাউকে নেতা বানানো বা, কাউকে সরিয়ে দেয়া পছন্দ করি না। এতে পার্টির ক্ষতি হয়। অতীতে যা হয়েছে হয়েছে, এখন আর পুনরাবৃত্তি হবে না।
এদিকে বিদায়ী মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, আমি কিছুই জানি না। কেন তিনি আমাকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দিলেন।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া নেয়ার জন্য একাধিক মিডিয়াকর্মী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মহাসচিব পদে আনা হয় রাঙ্গাকে। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর কাউন্সিলে পুনরায় মহাসচিব নির্বাচিত হন রাঙ্গা।
অন্যদিকে দলটির একজন ভাইসচেয়ারম্যান মানবকণ্ঠকে জানান, রাঙ্গার পদ যাবার কারণ রয়েছে। দলের শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মীর ফোন রিসিভ করত না। নেতাকর্মীরা তার কাছে মনের কথা বলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে কল দিলেও তিনি এড়িয়ে যেতেন।
তিনি আরো বলেন, তাই না, করোনা ও বন্যা পরিস্থিতিতে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির কাজ হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের পাশে থাকা। তাও করতে তিনি পার্টির মহাসচিব হিসেবে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
সূত্র জানায়, জিএম কাদেরের প্রমোশনের বিরোধিতা করে মহাসচিব পদ খুইয়েছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। সেই বাবলুকে এবার মহাসচিব পদে নিয়োগ দিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান খোদ জিএম কাদের। ক্ষমতা কিছুটা বেশি হলেও কো-চেয়ারম্যান বাবলুর এটি প্রমোশন হলো নাকি ডিমোশন হলো বলা কঠিন। যদি মহাসচিব পদ অতিরিক্ত দায়িত্ব হয় তাহলে এক রকম। আর যদি শুধু মহাসচিব পদ নির্ধারিত হয় তাহলে তাকে ডিমোশন বলাই যুক্তিযুক্ত হবে। জাপার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মহাসচিবের একধাপ উপরের পদ কো-চেয়ারম্যান। আর সেই পদেই ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমদে বাবলু।
রংপুরের জাতীয় পার্টির এক জনসভায় দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার ছোটভাই জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা দেয়ার সময় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন জিয়াউদ্দিন বাবলু। পার্টির চেয়ারম্যানের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তিনি। এমনকি রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে পাল্টা জাতীয় পার্টি গঠনের পক্ষেও কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রওশন এরশাদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করে ভাঙন ঠেকান এরশাদ।
২০১৬ সালের জানুয়ারি দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে মহাসচিব বাবলুকে অপসারণ করেছিলেন এরশাদ। তখন জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যান পদ বলে কিছু ছিল না। তবে ২০১৬ সালের কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র সংশোধনী এনে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান এবং কো-চেয়ারম্যান পদ যুক্ত করা হয়।
২০২০ সালের কাউন্সিলে কো-চেয়ারম্যান পদ বাড়িয়ে ৭ সদস্য করা হয়েছে। তখন আবার রওশনপন্থি বলে পরিচিত বাবলু হঠাৎ কাদেরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। যদিও তারা এখন বৈবাহিক সূত্রে শ্বশুর-জামাই সম্পর্কে আবদ্ধ।
২০১৭ সালের এপ্রিলে জিএম কাদের’র বোন মেরিনা রহমানের মেয়ে মেহেজেবুন নেসা টুম্পার সঙ্গে বিবাহে আবদ্ধ হন বাবলু। তবে জাতীয় পার্টির পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশের আগেই দলের মধ্যে আলোচনা না করে হঠাৎ মহাসচিবকে সরিয়ে দেয়ায় জাতীয় পার্টির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সূত্র: মানবকন্ঠ।