যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ নয়, বেধড়ক মারপিটে ৩ কিশোর নিহত!

susu unnoyon kendro jessore

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ নয়, কর্মকর্তা ও আনসার সদস্যদের বেধড়ক মারপিটে বন্দীদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি কিশোর বন্দীরা এ দাবি করেছে।

একই সাথে পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও প্রথমিক ভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ঘটনার প্রায় ৬ ঘণ্টা পর বিষয়টি জানা যায় বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম।

বৃহস্পতিবার ১৩ আগস্ট দুপুরের ওই ঘটনায় যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দের ৩ বন্দি নিহত ও আরও ১৪ জন আহত হন। নিহতরা হলেন, খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮) বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্ব পাড়ার নান্নু পরমানিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮)।

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে আসলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। আজকের ঘটনাটি একপাক্ষীক।’

তিনি বলেন, ঘটনাটি প্রায় ছয়ঘণ্টা পর জানা গেছে। স্থানীয় সংবাদকর্মীরাও ঘটনা জেনেছেন সন্ধ্যার পর, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। তিনি নিজেও রাত ১০টার পর ঘটনা জেনে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আসেন। এখানে কি এবং কেন এমন ঘটনা ঘটেছে তা পুলিশ তদন্ত করবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তদন্ত হবে। আর নিহত কিশোরদের স্বজনরা মামলা করলে পুলিশ মামলা নেবে। তদন্তাধিন ঘটনা হওয়ায় বেশিকিছু বলতে তিনি রাজী হননি।

রাতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যশোরের জলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, কিভাবে কিশোররা হতাহত হলো তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তের পরই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

এদিকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি বন্দী কিশোররা তাদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দেয়। তারা জানায়, ‘ঘটনার সূত্রপাত ৩ আগস্ট, ঈদের দু’দিন পর। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের আনসার সদস্য নূর ইসলাম কয়েকজন কিশোরের চুল কটে দিতে চান। কিন্তু কিশোররা চুল কাটতে রাজি না হওয়ায় তিনি কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেন, ওই কিশোররা নেশা করে। এর প্রতিবাদে ওই দিন কয়েকজন কিশোর তাকে মারপিট করে।’

আহত কিশোরদের দাবি, ‘ওই ঘটনার সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার ১৩ আগস্ট বেলা ১২টার দিকে ১৮ জন বন্দীকে রুম থেকে বাইরে বের করে আনা হয়। বিকেল ৩টা পর্যন্ত পালাক্রমে তাদেরকে লাঠিসোটা, রড দিয়ে বেধড়ক মারপিট করা হয়। পালাক্রমে এভাবে মারপিটের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ফেলে রাখা হয়। পরে কয়েকজন মারা গেলে সন্ধ্যার দিকে তাদের লাশ যশোর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

আহত কিশোররা জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আনসার সদস্য ও তাদের নির্দেশে কয়েকজন কিশোর ওই ১৮ জনকে বেধড়ক মারপিট করে। কয়েকজন অচেতন থাকায় তারা অজ্ঞান হয়ে গেছে মনে করলেও পরে তারা বুঝতে পারে মারা গেছে। পরে সন্ধ্যায় এক এক করে তাদের লাশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা ৭টায় রাব্বি, সুজন ও নাঈমকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসে।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অমিয় দাস বলেন, দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি মরদেহ আসে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিটে নাইম হাসান, সাড়ে ৭টায় পারভেজ হাসান ও রাত ৮টায় আসে রাসেলের মরদেহ।

চিকিৎসক অমিয় দাস বলেন, ‘একজনের মাথায় ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। অন্যদের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন এখনও শনাক্ত হয়নি।’

তিন কিশোরের মরদেহ হাসপাতাল মর্গে পড়ে থাকলেও সেখানে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কাউকে পাওয়া যায়নি। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদের নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার বক্তব্য নেয়ার জন্য সাংবাদকর্মীরা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে গেলে কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা ভিতওে ঢুকতে দেয়নি।

এক পর্যায়ে কেন্দ্রের প্রশিক্ষক মুশফিক দাবি করেন, ‘কয়েকদিন আগে সংশোধনাগারে শিশুদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়। ওই ঘটনার জের ধরে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে নাইম, রাব্বি ও রাসেল হোসেন গুরুতর আহত হয়। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।’

কেন্দ্রের সহকারী পরিচারক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ দাবি করেন, সংঘর্ষে দশজন আহত হয়েছে।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দী পাভেল ও রবিউলের নেতৃত্বাধীন দুটি গ্রুপ রয়েছে। এই দুই গ্রুপ বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটার দিকে লাঠি ও রড নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হলে হাতহতের ঘটনা ঘটে।

যশোর পুলিশের ডিএসবি ডিআই-১ পুলিশ পরিদর্শক এম মশিউর রহমান জানান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে হতাহতের ঘটনা দুপুরে ঘটলেও লাশ হাসপাতালে আনা হয়েছে সন্ধ্যার পর।
ঘটনা জানাজানির পর রাতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে যান যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেনসহ পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা। মধ্যরাতে খুলনা থেকে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, দেশে বালকদের জন্য দুটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে। কিশোর অপরাধীদের জেলখানায় না পাঠিয়ে সংশোধনের জন্য এই উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়।

কেন্দ্রটি সমাজসেবা অধিদফতর নিয়ন্ত্রন করে। যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রায়ই অঘটন ঘটে। লাশ উদ্ধার, মারপিটের ঘটনা আগেও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম জেঁকে বসেছে। এর আগে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি এ সব তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অবস্থার যে কোন উন্নতি হয়নি বরং আরো অবনতি হয়েছে, তিন লাশ উদ্ধারের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হলো।