বর্ষা শেষে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকে সাগর থেকে উদ্ধার করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে পাঠানো হয়। তারা সেখানে ভালো আছেন। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চলতি বর্ষা মৌসুম শেষে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের কথা ভাবছে সরকার।

সোমবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার কানাডিয়ান হাইকমিশনের যৌথ উদ্যোগে ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: পশ্চিমা, এশিয়ান এবং দ্বিপক্ষীয় প্রসঙ্গ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে এসব তথ্য জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘চলতি বর্ষা মৌসুম শেষে সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর কাজ শুরু করতে চায়। তবে সেটা অবশ্যই শুরু করা হবে ‘গো অ্যান্ড সি’ প্রোগ্রামের আওতায়, এটাই প্রথম করা হবে। সাগর থেকে ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে আমরা উদ্ধার করে ভাসানচরে রেখেছি। সেখানে তারা ভালো আছেন।’

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজ শুরু করার আগে সরকারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য সেখানে জাতিসংঘ প্রতিনিধিকে সেখানে নিয়ে যাবে সরকার। একইসঙ্গে সেখানে সরকার মানবাধিকারকর্মী এবং গণমাধ্যমকর্মীদের দেখাতে নিয়ে যাবে।’

ভাসানচরে বসবাসরত রোহিঙ্গারা গত মে মাসে দেশে ঘটে যাওয়া আম্পানে কোনো সমস্যা পড়েনি বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য ভাসানচরটি প্রস্তুত করা হয়েছে বলেও জানান মাসুদ বিন মোমেন।

দীর্ঘদিন থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি অংশকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরে চেষ্টা চালাচ্ছিল সরকার। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তির কারণে সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সরকারের সরে আসার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ পরিস্থিতি দেখতে ১৩ ফেব্রুয়ারি সেখানে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপরই ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর থেকে সরকার আপাতত সরে আসছে বলে আলোচনার শুরু হয়।

পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনাও এটা নিয়ে কথা বলেন। এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকন্যা জানান, রোহিঙ্গা সেখানে না যেতে চাইলে আমাদের দেশের অসহায় মানুষকে সেখানে রাখা হবে।

নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার–জলোচ্ছ্বাস থেকে এই চরের ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করেছে। এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য সেখানে ১২০টি গুচ্ছ গ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

‘রোহিঙ্গাদের ফেরাতে কথা রাখেনি মিয়ানমার’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়া প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরতে মিয়ানমার দুই দফায় সম্মত হলেও দেশটি কথা রাখেনি। বাংলাদেশ সবসময়ই চেয়েছে শান্তিপূর্ণ সমাধান। অন্যদিকে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন শুরু না করার প্রক্রিয়া হিসেবে প্রত্যাবাসনকে নিরুৎসাহিত করার কৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে।’

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘কঠিন যে বাস্তবতা আমাদের মনে রাখতে হবে সেটি হচ্ছে মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। সে দিক থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের প্রতি সব সময় এক আদর্শ প্রতিবেশীর মতো আচরণ করে এসেছে। কিন্তু অনেক সময়ই মিয়ানমার সেই জায়গা থেকে বিচ্যুত ছিল।’

এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও বেশি সহযোগিতা কামনা করেন পররাষ্ট্র সচিব।

অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব ছাড়াও মালেশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ হামিদ আলবার, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার, কানাডিয়ান হাইকমিশনার বেনোইট প্রেফোনটাইনি, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বক্তব্য দেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সবসময় বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। রাষ্ট্রদূত মিলার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আশাবাদী। কূটনৈতিক উপায়ে এই সমম্যার সমাধান করতে হবে।’ এ সময় মিলার করোনাকারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার কথা তুলে ধরেন।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ‘মিয়ানমার শুরু থেকেই সময়ক্ষেপণ করে আসছে। পরপর দুবার মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। এখনো বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন শুরুর পথ খুঁজছে।’

কানাডিয়ান হাইকমিশনার বেনোইট প্রেফোনটাইনি তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তার দেশ কানাডার ওপর অব্যাহত চাপ বজায় রাখবে বলে আশ্বস্ত করেন।