টিকার পরও অনিরাপদ থাকবে লাখো মানুষ

করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা নিয়ে মানুষের মনে নতুন করে আশা জেগেছে গত মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের কথায়। চলতি বছরের শেষ নাগাদ টিকা মিলছে বলে তিনি আভাস দিয়েছেন। টিকা উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় থাকা একাধিক প্রতিষ্ঠানও ওই একই আভাস দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার করোনার টিকা পেতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নিয়েছে। টিকা ক্রয়ে অর্থও বরাদ্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতির বিষয়ে গত বুধবার মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে অবহিত করেছেন। তার আগের দিন এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও টিকা নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন।

কিন্তু এতসব সুখবরের পরও বিশেষজ্ঞরা চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না। কারণ যতগুলো টিকা হাতের নাগালে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, এর কোনোটিরই কার্যকারিতা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের বেশি নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই টিকা যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের শরীরে কাজ করবে না তারা টিকা নেওয়ার পর নিজেদের নিরাপদ ভাবলেও বাস্তবে নিরাপদ নয়। অর্থাৎ টিকার বাইরে থাকা মানুষের মতো তারাও অনিরাপদ। আবার কোন টিকা কত দিন পর্যন্ত মানুষের শরীরে কার্যকর থাকবে, তা-ও এ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফলে টিকা নিয়ে খুব বেশি উৎসাহিত হওয়ার সুযোগ নেই। বরং টিকার চেয়েও বড় সুফল পাওয়া যাবে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, নিয়ম মেনে মাস্ক ব্যবহার ও হাত ধোয়ার মাধ্যমে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিজ্ঞানী বলেন, ‘মনে করুন, দেশে যদি ১০ লাখ টিকা আসে এবং তা ১০ লাখ মানুষকে দেওয়া হয়, এর মধ্যে হয়তো ছয় থেকে সাত লাখ মানুষ নিরাপদ হবে। বাকি তিন থেকে চার লাখ মানুষ অনিরাপদই থেকে যাবে। কারণ এই তিন থেকে চার লাখ মানুষের শরীরে টিকা অ্যান্টিবডি তৈরি করবে না। ফলে তারা ঝুঁকির মধ্যেই থেকে যাবে।’

টিকা বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা ইনস্টিটিটের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ড. কে এম জামান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শতভাগ কার্যকর কোনো টিকা উদ্ভাবন হয়নি। করোনার টিকার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ৫০ শতাংশের নিচে কার্যকর কোনো টিকা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ কথায় বুঝাই যায়, ৫০ শতাংশের ওপর কার্যকারিতা পাওয়া গেলে অন্যসব প্রটোকল ঠিক থাকলে তা প্রয়োগ করা যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, টিকা গ্রহণের পর যাদের শরীরে কাজ করবে তারা নিরাপদ, আর যাদের শরীরে কাজ করবে না তারা অনিরাপদই থেকে যাবে।’

বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ রিসার্স ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অণুজীব বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা বলেন, ‘৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরেও যদি টিকা কার্যকর হয় বাকিদের কি হবে? কেউ তো জানবে না তার শরীরে টিকা কাজ করছে কি না। ফলে টিকা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘আরেকটি বিষয়, এ পর্যন্ত টিকা নিয়ে সর্বাধিক কাজ করছে আমেরিকা ও চীন। তাদের কাছ থেকে কবে নাগাদ আমরা টিকা পাব তা নিশ্চিত নয়। এ দুটি দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভেক্স উদ্যোগে অংশ নেয়নি। ফলে তাদের টিকা কবে কোভেক্সে যাবে, কবে নাগাদ অন্য দেশে পাঠাতে পারবে, তা এখনো প্রশ্ন সূচকই থেকে যাচ্ছে।’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) বিজ্ঞানী ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘সোজাসাপ্টা বললে, টিকা আসুক বা না আসুক, আমাদের আরো দীর্ঘদিন নিজের এবং অন্যের সুরক্ষায় মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়া, দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। একসঙ্গে এই তিনটি বিষয় পালন করলে টিকার সমান উপকার পাওয়া যাবে। টিকা গ্রহণকারীদেরও এ তিনটি বিষয় মেনে চলতে হবে যত দিন করোনা পৃথিবী থেকে নির্মূল না হচ্ছে।’

অন্যদিকে করোনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি ঝুঁকির। আমেরিকার মডার্নার টিকা ছাড়া অন্য কোনো টিকা এখনো বয়স্কদের জন্য প্রয়োগযোগ্য বলে নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে বয়স্ক জনগোষ্ঠী নিয়েও ঝুঁকি থাকছে।

তবে অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে করোনার সংক্রমণ অন্য দেশের চেয়ে ব্যতিক্রম বলেই মনে হচ্ছে। জীবনব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধিও তেমন মানা হচ্ছে না। তার পরও আমরা ভয়ানক কোনো পর্যায়ে যাইনি। এ অবস্থায় টিকা অকার্যকর হওয়ার যেসব কথা বলা হচ্ছে, আবার অন্যদের চেয়ে বেশি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলার সময় আসেনি।’