বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে বাবা-মায়ের কাছে ঘুমিয়ে থাকা তিন মাস বয়সী শিশু আব্দুল্লাহকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি দণ্ডিত প্রত্যেককে পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে।
রবিবার দুপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বাগেরহাট-২ এর বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. নূরে আলম আসামিদের উপস্থিতিতে এই রায় ঘোষণা করেন।
দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন- বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার গুলিশাখালী গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেন হাওলাদারের ছেলে মো. হ্নদয় ওরফে রাহাত হাওলাদার (২১), একই গ্রামের জসিম সোবাহান হাওলাদারের ছেলে মো. মহিউদ্দিন হাওলাদার (২২) ও আব্দুর রশিদ হাওলাদারের ছেলে মো. ফায়জুল ইসলাম (২৮)। এরা সবাই একই বংশের।
আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও হত্যার তিনটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আইনের তিনটি ধারায় এই দণ্ডাদেশ দেন বিচারক।
চাঞ্চল্যকর শিশু হত্যা মামলাটি আমলে নিয়ে আদালত ২০২০ সালের ৯ মার্চ চার্জ গঠন করে। এরপর শুরু হয় আসামি, বাদী, পুলিশ, চিকিৎসক, সাধারণ সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক। ৯ মার্চ থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত সাত কার্য দিবসে চাঞ্চল্যকর শিশু হত্যা মামলাটির বিচার কাজ শেষ করেন আদালত।
৯ মার্চ মামলার চার্জ গঠন ১১ , ১২, ১৫, ১৬. ১৭ নভেম্বর সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ, ২২ নভেম্বর সাক্ষীদের সাফাই সাক্ষ্য এবং ২৫ নভেম্বর বাদী বিবাদীর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়।
মামলার নথির বরাত দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রণজিৎ কুমার মন্ডল বলেন, ২০১৯ সালের ১১ মার্চ দিনগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিশারীঘাটা গ্রামের দলিল লেখক সোহাগ হাওলাদারের বাড়ির জানালার গ্রিল কেটে তাদের পাশে ঘুমিয়ে থাকা ছেলে আব্দুল্লাহকে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরদিন ওই দুর্বৃত্তরা শিশু আব্দুল্লাহর পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
শিশুটির বাবা সোহাগ তাদের দাবি করা মুক্তিপণের টাকা দিলেও শিশুটিকে তারা ফিরিয়ে না দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়রা তাদের ধাওয়া করে। পরে তারা মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যায়।
এই ঘটনায় শিশু আব্দুল্লাহর বাবা সোহাগ হাওলাদার অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মোরেলগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। পরে পুলিশ উদ্ধার হওয়া ওই মোটরসাইকেলের সূত্রধরে প্রথমে মো. হৃদয় ওরফে রাহাত হাওলাদারকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। অভিযুক্ত হৃদয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাদীর বাড়ির অদূরের একটি মাছের ঘেরের শৌচাগারের সেপটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে শিশু আব্দুল্লাহর মরদেহ উদ্ধার করে। জড়িত দুই সহযোগী মহিউদ্দিন ও ফায়জুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরে আসামী হৃদয় শিশু আব্দুল্লাহকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. আব্দুল মতিন তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় ২৫ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে শিশুটিকে হত্যা করেছে বলে সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পুলিশের তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
সরকার পক্ষের আইনজীবী বলেন, এই রায়ে আমরা খুশি। একটি মামলার বিচার কাজ শেষ করতে যেসব তথ্য প্রমাণ থাকা দরকার তা এই মামলায় ছিল। যার কারণে অল্প সময়ে মামলাটি বিচার কাজ শেষ হয়েছে। মামলার সংশ্লিষ্টরা যদি যথাসময়ে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে তাহলে সব ধরনের মামলাই যে অল্প সময়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভব তার প্রমাণ এই আদালত।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. এনামুল হোসেন বলেন, আমরা এই মামলায় ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। শুধুমাত্র প্রধান আসামি হৃদয়ের ১৬৪ ধারার জবানবন্দির উপর ভিত্তি করে ফায়জুল ও মহিউদ্দিনকে দণ্ড দেয়া হয়েছে। তারা এই ঘটনায় জড়িত নয়, তা আমি আমার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আদালতে উপস্থাপন করেছি। আদালতের রায়ের কপি হাতে পেলে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।
শিশুটির বাবা দলিল লেখক সোহাগ হাওলাদার এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আর যেন কোনো বাবা-মাকে এভাবে সন্তানহারা না হতে হয়। এই রায় ঘোষণার পর আগামীতে অপরাধীরা এই ধরনের অপরাধ করার ধৃষ্টতা দেখাবে না বলে মন্তব্য করেন এই বাবা।