বিজয় দিবসে গদখালীতে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা

ফুলের রাজধানী যশোরের গদখালীর পাইকারি ফুলের বাজারে চাষীরা এবার ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন। এখান থেকে গত চার দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত সাত কোটি টাকার ফুল গেছে। বাকি চার দিনে আরো ১৩ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা সকলের। করোনা পরিস্থিতিতে হলেও এবার গতবারের তুলনায় আশা জেগেছে ফুল চাষীদের মাঝে। তাছাড়া পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ায় এবার ফুল বিক্রির পরিমান যেন হঠাৎ করেই খানিকটা বেড়েছে।

গদখালী ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, গদখালীর ৪০ শতাংশ ফুল ঢাকা ও চট্টগ্রাম এবং ৬০ শতাংশ ফুল চালানের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছোটবড় বাজারে পাঠানো হয়। ওই সব চালানের হিসাব অনুযায়ী আজ শুক্রবার পর্যন্ত সাত কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে।

সরেজমিনে গদখালী বাজারে গিয়ে প্রতিটি গোলাপ ৫-৭ টাকা, জারবেরা ১০-১৬ টাকা, গ্লাডিওলাস ৩ থেকে ৬ টাকা, রজনীগন্ধা ৫/৬ টাকা এবং গাঁদা প্রতি হাজার দেড় থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর যশোর জেলায় ৬০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুলের চাষ হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার কৃষক।
অন্যদিকে কৃষি বিভাগের তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে গদখালী ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বলেন, এক হাজার ৪০০ থেকে ৫০০ হেক্টর জমিতে এবার ফুলের চাষ হয়েছে। আর ফুল চাষে সম্পৃক্ত আছেন ছয় হাজার কৃষক।

গত চার দিন গদখালী বাজারে ভোরে চাষিরা প্রচুর পরিমাণে গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চায়না লং স্টিক রোজ প্রভৃতি ফুল নিয়ে আসেন। বাজারে জায়গা না হওয়ায় তাঁদের অনেককেই আবার ফুল নিয়ে যশোর-বেনাপোল সড়কের ওপর বসছেন। সকাল ১০টার মধ্যেই সব ফুল কিনে ব্যবসায়ীরা ট্রাক কিংবা বাসের ছাদে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে নিয়ে যান বা পাঠিয়ে দেন। আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস, ১লা জানুয়ারি ইংরেজী নববর্ষ উদযাপন, বাঙালির বসন্ত বরণ উৎসব ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস সামনে রেখে প্রতিবছরই যশোর অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের আগাম প্রস্ততি থাকে।

যশোর অঞ্চলের চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে ফুলের আবাদ ও ব্যবসা বেশ লাভজনক। এখানে ফুল চাষী, পাইকরি ও খুচরা বিক্রেতা ছাড়াও এই খাতে অটো ভ্যান, ইজিবাইক, নসিমন, ছোট পিকআপ মালিকদের স্বার্থ জড়িত।
ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের চাষি আমিনুর রহমান গত চার দিনে তিন লক্ষ টাকার জারবেরা ফুল বিক্রি করেছেন।

উল্লেখ্য, যশোর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী বাজার। দেশে ফুলের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করে থাকেন এই অঞ্চলের কৃষকেরা।

তিন বছর আগের বসন্তবরণ ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে গদখালীর ফুলচাষিরা নতুন উপহার হিসেবে এনেছিলেন লং স্টিক রোজ। ভারতের পুনে থেকে চারা এনে ৪০ শতক জমিতে দেশে প্রথমবারের মতো বিশেষ ধরনের গোলাপের জাতটির চাষ শুরু করেছিলেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা গদখালীর ইনামুল হোসেন। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য জাতের গোলাপ ফুল গাছ থেকে তোলার পর যেখানে ৪-৫ দিনের বেশি রাখা যায় না, সেখানে লং স্টিক গোলাপ রাখা যায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। এর স্টিক বেশ শক্ত। দামও মিলছে দ্বিগুণ। এসব কারণে ইনামুলের দেখাদেখি এ অঞ্চলের বেশিরভাগ চাষির মাঠে শোভা পাচ্ছে গোলাপের নতুন এই জাত।
এবার নতুন জাতের ফুল উপহার দিতে না পারলেও এখানকার চাষিরা ফুলপ্রেমীদের দিচ্ছেন চমকপ্রদ খবর। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জারবেরা চারায় ফুল ফোটাচ্ছেন তারা। অল্প অল্প করে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এতদিন বেঙ্গালুরু থেকে চারা এনে জারবেরা চাষ করতেন চাষিরা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আরআরএফ যশোরের টিস্যু কালচার সেন্টার জারবেরার চারা তৈরি করছে।

এবার নতুন জাতের ফুল না এলেও এখন প্রস্তুতি চলছে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ১লা জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ফাগুন উৎসব ও ভালোবাসা দিবস এবং মহান ভাষা দিবসকে সামনে রেখে ফুল উৎপাদনের। ফুলের রঙে রঙিন হয়েছে ফুলের রাজধানী খ্যাত গদখালী। ফুলের বাগানে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এখন ফুলের ভরা মৌসুম তাদের টার্গেট কয়েকটি উৎসব। সে কারণেই এত তোড়জোড় ও ব্যস্ততা তাদের।

লং স্টিক রোজের পাশাপাশি গদখালী-পানিসারা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন দোল খাচ্ছে জারবেরা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা ও চন্দ্র মলিল্গকাসহ হরেক রকমের ফুল। বাতাসে ফুটন্ত ফুলের সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় ফুলের হাসি লেগেছে চাষিদের চোখেমুখেও।

পানিসারার ফুলচাষি সাহিদা বেগম বলেন, এখন চাষিরা গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রেখেছেন, এতে ফুল একটু দেরিতে ফোটে। প্রতিটি গোলাপে ক্যাপ পরানোসহ খরচ প্রায় পাঁচ টাকার মতো। যদি ৮-১০ টাকা বিক্রি করা যায়, তাহলে মুনাফাও হবে ভালো।

জারবেরা ফুল ব্যবসায়ী আলম বলেন, এখন প্রতি সপ্তাহে ৬-৭ হাজার পিস ফুল বিক্রি হচ্ছে। সামনের উৎসব সামনে রেখে তারা তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন। গদখালীর ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন জানান, পৈতৃক জমিতে তিনি আগে ধান-পাট ও রবিশস্যের আবাদ করতেন। এখন সেখানে ফুল চাষ করেন। এতে তিনি আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হয়েছেন।

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক এমদাদ হোসেন জানান, এবার জেলায় ৬৫০ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করা হয়েছে। দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগের বেশি যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ফুল এখন যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ায়।
অন্যদিকে ইউরোপের বাজারে ফুল রপ্তানির আশায় পলি হাউসে ফুলের আবাদ করছেন এখন চাষিরা। তারা বলছেন, পলি হাউসে তাপমাত্রা সঠিক মাত্রায় থাকার কারণে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী গোলাপ ফুল উৎপাদন হবে।

গদখালী ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা এই ফুলকে কেন্দ্র করে। প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুলচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল যশোরেই ছয় হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। দাম বাড়ার কারণে এবার বিক্রি ৩০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

দেশে ফুলের বিশাল এই বাণিজ্য শুরু হয়েছিল জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারায়। আশির দশকে এই গ্রামে প্রথম শুরু হয়েছিল বাণিজ্যিক ফুল চাষ। এখানকার ফলদ ও বনজ গাছের নার্সারির মালিক শের আলী গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন ফুল চাষের। সেই শুরু এখন দক্ষিনাঞ্চলে লাখো পরিবারের আয়ের খাত ফুল খাত।

শের আলীর পৈতৃক ব্যবসা ছিল নার্সারি। ফলদ ও বনজ গাছের চারা উৎপাদন ও বিপণন করতেন তিনি। যশোর-বেনাপোল সড়কের গদখালীতে ছিল তার সেই নার্সারিটি। সেখানে বসে আলাপকালে নূর ইসলাম তাকে ফুল চাষের পরামর্শ দেন। ব্যবস্থা করে ভারত থেকে এক বস্তা রজনীগন্ধার বীজ এনে দেন। ওই বীজ দিয়ে তিনি পানিসারা গ্রামের নিজের ৩০ শতক জমিতে রজনীগন্ধার চাষ করেন।

শের আলী বলেন, প্রথম যখন ফুলের চাষ শুরু করেছিলাম, লোকজন আমাকে পাগল বলত। ধান-পাট আবাদ না করে ফুল চাষে হাস্যরসের খোরাক হয়েছিলেন তিনি সবার কাছে। তবে প্রথম চালান দুই লাখ টাকায় বিক্রির পর তাক লেগে আস্তে আস্তে একের পর একজন চাষী এই খাতে নাম লেখান।

এখন পুরো অঞ্চলে ফুলের আবাদ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে শের আলী বলেন, ব্যাপারটা আর কিছু নয়। পাশাপাশি বসবাস ও দেখাদেখি চাষ-বিষয়টা এমনি। অর্থাৎ ফুল চাষে তার আকাশচুম্বী লাভ দেখে পাশের কৃষক এদিকে ঝুঁকে পড়েন। এলাকার ১২ জন কৃষককে প্রথম ফুল আবাদের পর উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করেন তিনি।

এরপর থেকে শুরু হয় ১২ ফুলচাষির একসঙ্গে পথচলা। তাদের ফুলের ওপর ভরসা করে ঢাকার শাহবাগে গড়ে ওঠে মালঞ্চ নামে রাজধানীর প্রথম ফুলের দোকান। শুরু হয়েছিল ৩০ শতক জমি দিয়ে। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০ বিঘা। এখন তার তত্ত্বাবধানে বড় ছেলে যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায় ফুল চাষের খামার গড়ে তুলছেন।
বর্ষীয়ান এ চাষি জানান, শুধু প্রথম ১২ জনকে নন। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে সবসময় বিনামূল্যে বীজ দিয়েছেন তিনি।