যশোরে দাবি আদায়ে হরিজনদের বিক্ষোভ মিছিল

বর্জ্য সংগ্রহকারী ভ্যান চালকদের (বাঁশিওয়ালা) কাজে এনজিওর অপতৎপরতা বন্ধ, পরিচ্ছন্নতা শ্রমিকদের প্রবিধান অনুযায়ি মজুরি প্রদান, ছাঁটাই বন্ধ ও অহরিজনদের পরিচ্ছন্নতা কাজে চাকরি না দেওয়াসহ শ্রম আইন বাস্তবায়নের দাবিতে যশোর পৌরসভা শ্রমিক ইউনিয়ন বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকাল ৫টায় বিক্ষোভ মিছিলটি লালদীঘির পাড় থেকে শহর প্রদক্ষিণ করে যশোর প্রেসক্লাবের সামনে সংক্ষিপ্ত পথসভার মাধ্যমে শেষ হয়।

পথসভায় যশোর পৌরসভা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মতি লাল হরিজনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ সম্পাদক বিষ্ণু হরিজন, যশোর পৌরসভা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কমল বিশ্বাস, সহ-সাধারণ সম্পাদক হিরণ লাল সরকার প্রমুখ

নেতৃবৃন্দ বলেন, হরিজনরা পরিচ্ছন্নতা কর্মি হিসেবে বংশ পরমপরায় যশোর পৌরসভায় কাজ করে আসছে। পাক-ভারত উপমহাদেশের একটি নিস্পেষিত, নির্যাতিত, শোষিত, অবহেলিত, পশ্চাদপদ, অস্পৃশ্য, অচ্ছুত সম্প্রদায়ের নাম হরিজন। যশোর নামক এই নগরীর এবং অত্র পৌরসভার জন্মলগ্ন থেকেই হরিজনরা নগরীর সকল প্রকার বর্জ্য-আবর্জনা পরিস্কার করে নগর জীবনকে আধুনিক পর্যায়ে আনার ক্ষেত্রে অবদান রেখে আসছে। কিন্তু আমাদের জীবনে নেই আধুনিকতার ছাপ। বাঁচার মত মজুরি নেই, বসবাসের উপযোগি বাসস্থান নেই। নেই শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার ভোগের সুযোগ। হরিজনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়নি শ্রম আইন ও সরকারী নীতি-নির্দেশনা। কর্মে যন্ত্রের ব্যবহার আমাদের কাজের সুবিধার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত কর্মহীনতা বৃদ্ধি করছে। বিকল্প কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা নেই। নিজ উদ্যোগে কাজের ব্যবস্থা করতে গেলেও সামাজিক কারণে তা করতে পারা যায় না। ফলশ্রুতিতে হরিজনরা আজো অনগ্রসর সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক নেই। গেজেট অনুযায়ী মজুরিসহ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি না। এমনকি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে আসছে। কখনও ২২ টাকা, কখনও ৩৩ টাকা কখনও ৩৮ টাকা দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে যা বর্তমানে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দাঁড়িয়েছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ (প্রবিধি অনুবিভাগ, প্রবিধি-৩ অধিশাখা) স্মারক নং-০৭.০০.০০০০.১৭৩.৬৬.০৫৯.১৫-৩৪ (তারিখ: ২৪/০৫/২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ/১০/০২/১৪২৩ বঙ্গাব্দ) স্বাক্ষরিত ২০/০৬/২০১৬-এ দৈনিক মজুরি সাড়ে ৪ শ টাকা আমরা পাই না যা ১২/১০/২০২০ তারিখে ০৭.০০.০০০০.১৭৩.৬৬.০৫৯.১৫ (অংশ-১)-৯৩ নং স্মারকে দৈনিক ভিত্তিক পুনঃমজুরি হার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে ৩০ দিনই কাজ করে যাচ্ছে। অথচ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে না, পারে না কোন ছুটি কাটাতে। তাছাড়া রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মাসে ৩০ দিন কাজ করার পর অসুস্থ্ হলে পায় না কোন প্রকার চিকিৎসা সুবিধা। একদিন অনুপস্থিত হলে চাকুরিচ্যূত হতে হয়। সারাজীবন শ্রম দেওয়ার পর শ্রমিকের মৃত্যুতেও পায় না কোন সুযোগ-সুবিধা।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, করোনা মহামারী মোকাবেলায় ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মিদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে আমরা পরিচ্ছন্নতা কর্মিরা সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে চলেছি। কিন্তু আমাদের জীবনের সমস্যা সঙ্কট অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এ পর্যায়ে আমাদের ভ্যান চালকরা (বাঁশিওয়ালা) স্বউদ্যোগে পৌরসভার বিভিন্ন এলাকার বাড়ি বাড়ি থেকে কিছু বকশিশের বিনিময়ে রান্নাঘরের ব্যবহৃতসহ অন্যান্য বর্জ্য সংগ্রহ করে আসছিল। কিন্তু এখানেও আমাদের অসহায়তা উদ্ধারের দাবিদার এনজিও এডিবি প্রকল্পের অজুহাত দেখিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজে তত্ত্বাবধানের নামে অর্থলোপাটের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। এমনিতে হরিজনদের যে মজুরি তা দিয়ে মোটেও সংসার চলে না। আমরা বাধ্য হয়ে বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ করে যে বকশিশ পাই তা দিয়ে কোন রকমে বেঁচে আছি। সেখানেও থাবা বাগিয়ে কর্তৃপক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অজুহাতে এনজিওদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বাসা বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সংগ্রহের কাজ আমাদের মাধ্যমে করাতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এনজিওরা সার্ভিস চার্জের নামে ৫০/১৫০/১০০/২০০ টাকা বাসা প্রতি নিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করছে। অথচ নামমাত্র বকশিশের বিনিময়ে আমরা এ কাজ করে আসছিলাম। এ কারণে আমাদের একদিকে উপার্জন বন্ধ অন্যদিকে নাগরিকদের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এনজিও ‘মানবতা’ রক্ষার নামে এতদিন হরিজন সম্প্রদায়কে বুঝিয়েছে যে, তারা আমাদের (হরিজন) সামগ্রিক উন্নয়নের পক্ষে কাজ করছে। আজ তাদের (এনজিও) মুনাফালোভী আসল চরিত্র ফুটে উঠেছে। তারা রোড বা মহল্লা অনুযায়ী যা টাকা তুলে তার অর্ধেক দিয়ে আমাদের কাজ করিয়ে বাকী টাকা পকেটে পুরবে। এ ছাড়াও অহরিজনদের এই পেশায় যুক্ত করে আমাদের কর্মের একমাত্র অবলম্বনও ছিনিয়ে নিতে চায়। পরিবারের সবাই মিলে কাজ করেও পেট চলে না। আমাদের কর্মক্ষেত্রে এনজিওদের অপতৎপরতা বন্ধ না করে উল্ট নেতৃবৃন্দের নামে থানায় মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করে হয়রানি করছে। সুতরাং জীবন-জীবিকার তাগিদে দুর্বার আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নাই। নেতৃবৃন্দ শ্রম আইন বাস্তবায়নের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।