বজ্রপাত কেন হয়, সুরক্ষায় করণীয় কী?

দক্ষিণ এশিয়ায় বজ্রপাতপ্রবণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। বিগত বছরগুলোতে দেশে বজ্রপাতের তীব্রতা বেড়েছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। ২০১৩-২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে ১ হাজার ৮৭৮ জন মারা গেছেন। তবে কিছু বিষয় মেনে চললে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ডক্টর টিভি।

বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বজ্রপাত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বা আক্রান্ত হলে কী করা যাবে আর যাবে না তা জেনে রাখা খুবই জরুরি।

কেন বজ্রপাত হয়

বাংলাদেশের দক্ষিণ থেকে আসা গরম আর উত্তরের ঠান্ডা বাতাসে সৃষ্ট অস্থিতিশীল আবহাওয়ায় তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এ রকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে হয় বজ্রপাত। এ সময় উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে কাছে যা পায় তাতেই আঘাত করে।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগলিক অবস্থান। একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে আসছে গরম আর আর্দ্র বাতাস। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা। কিছু দূরেই হিমালয় পর্বত। যেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসে। এই দুই জায়গা থেকে আসা বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ৫০ ভাগ বেড়ে যায়। গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলাও তার একটি কারণ। উঁচু গাছপালা বজ্রনিরোধক হিসেবেও কাজ করে। খোলা স্থানে মানুষের কাজ করা এবং বজ্রপাতের বিষয়ে অসচেতনতাও বজ্রপাতে প্রাণহানি বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

বাংলাদেশে বজ্রপাতের কারণগুলোর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে প্রথম ও প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। যদিও অনেক জলবায়ু বিজ্ঞানী এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন।

আবহাওয়াবিদ উইং কমান্ডার মো. মোমেনুল ইসলাম (অব.) বলেন, এপ্রিল থেকে জুন এর মধ্যেই বেশি বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হলে বায়ুমণ্ডল বেশি জলীয়বাষ্প ধারণ করতে পারে, তাই বেশি বজ্রঝড় তৈরি হতে পারে। বনায়ন কমে গেলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। কারণ হিসেবে বলা যায়, গ্রিন হাউস কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে গাছপালার খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার করে।

বর্তমান সময়ে বজ্রপাত বেড়েছে উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘ইদানীং বজ্রপাত অনেক লোক মারা যাচ্ছে। আমরা সাধারণত দেখতে পাই যে তাপমাত্রা বেড়েছে। বজ্রপাত বাড়ার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, আমাদের ইকনোমিক অ্যাক্টিভিটি বেড়েছে।’

‘এছাড়াও বলা যায়, বজ্রপাতের যে তীব্রতা ছিল তাও কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে যেখানে বেশি লোক বজ্রপাতে মারা যায়, তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়াও এর একটি কারণ হতে পারে। আর আগের চেয়ে বজ্রপাত রিপোর্টিং সিস্টেমটাও বেড়েছে’ যোগ করেন তিনি।

কোন সময় বজ্রপাত বেশি হয়

পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ৮০ লাখ বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। ২০১৯–২০ সালের মধ্যে দেশে বজ্রপাত হয়েছে ৩১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। দেশে সারা বছর যে পরিমাণ দুর্যোগ হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬ শতাংশ হয় মে মাসে।

ঋতুভিত্তিক বিন্যাসেও বজ্রপাতের ধরনে পার্থক্য রয়েছে। মার্চ থেকে মে মাসে প্রায় ৫৯ শতাংশ, আর মৌসুমি বায়ু আসার সময়, অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ বজ্রপাত হয়। তবে মোট বজ্রপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ হয় এপ্রিল থেকে জুনে।

গত ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। গবেষণায় দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টা হিসাবে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে ১২ শতাংশ। আর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত হার ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।

গবেষণা বলছে, ২০১৩-২০২০ (জুন পর্যন্ত) দেশে মোট ১ হাজার ৮৭৮ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। বজ্রপাতে দেশে বছরে প্রাণহানি প্রতি ১০ লাখে ১ দশমিক ৬ জন।

বজ্রপাতের সময় করণীয়

বজ্রপাতের সময় করণীয়, আহতদের চিকিৎসা এবং প্রাণহানি কমানোর উপায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, বজ্রপাত একটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বজ্রপাতে শরীরে বৈদ্যুতিক শক হয়। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় হার্ট এবং ব্রেইন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং অনেকেই অবশ হয়ে যেতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ হয়ে যেতে পারে প্যারালাইজড। যারা মারা যান, তার চেয়ে কয়েকগুণ জটিলতায় ভোগেনে বেঁচে যাওয়ারা।

ডা. এম এ ফায়েজ বলেন, কেউ যখন বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাকে বাঁচানোর জন্য প্রাথমিক কিছু বিষয় করা যেতে পারে। যদি শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তাকে সিপিআর চালিয়ে রাখতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

তিনি বলেন, বজ্রপাত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় কী করা যাবে আর যাবে না তা গুরুত্বপূর্ণ। মাঠে-ঘাটে, নদীতে-পানিতে, বাইরে যারা কাজ করেন, বিশেষ করে যারা গ্রামে কৃষিকাজ করেন, তারা বজ্রপাতে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে হবে।

‘মাটির সঙ্গে যেন স্পর্শ কম হয়, এমনভাবে বসে থাকা। দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরতে হবে। তবে গাছের নিচে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। ঘরের ভেতরে অবস্থান করলে, দরজা-জানালার পাশে না দাঁড়ানো ভালো। যদি কেউ পানিতে থাকে, তাকে অবশ্যই তাড়াতাড়ি পানি থেকে উঠে আসতে হবে’ যোগ করেন এই বিশেষজ্ঞ।

তিনি আরও বলেন, যারা বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং বেঁচে গেছেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন- বিদ্যুৎ স্পর্শ দেখেছেন, কিন্তু শব্দ শুনেননি। এছাড়াও তাদের কানে শুনতে সমস্যা হয়; পর্দা ফেটে যেতে পারে।

ডা. এম এম ফায়েজ বলেন, বজ্রপাতে অনেকেরই বধির হয়ে যাওয়াসহ চোখের সমস্যা হতে পারে। ব্রেনে রক্তক্ষরণ হতে পারে। হাড় ভেঙে যেতে পারে। মাথার তালু ভেঙে যেতে। মাংসপেশি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে তাদের কিডনি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, যদি কেউ খালি মাঠে বা পানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে সমতল ভূমির তুলনায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির উচ্চতা বেশি হওয়ায় তিনি সরাসরি বজ্রপাতের শিকার হতে পারেন।

আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমাতে সরকারের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে জনগণকেও। ঝড়-বৃষ্টির সময় বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি বজ্রপাত প্রতিরোধের নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। আর বেশি করে তালগাছসহ বিভিন্ন গাছপালা লাগাতে হবে। তাহলে অনেকাংশে কমে আসবে বজ্রপাতে মৃত্যু।