বিশ্ববাজারে আরো কমেছে জ্বালানি তেলের দাম

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমেছে। এক দিনের ব্যবধানে অপরিশোধিত তেলের দর সাড়ে ৩ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৭৫ ডলারে নেমে এসেছে। এ দর গত দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।

রয়টার্স ও সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সংরক্ষিত তেল বাজারে ছাড়ায় বিশ্ববাজারে পণ্যটির দামে পতন লক্ষ করা যাচ্ছে।

শনিবার অপরিশোধিত ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম আগের দিনের চেয়ে ২ ডলার ৭৩ সেন্ট বা ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৭৫ ডলার ৬৮ সেন্টে বিক্রি হয়েছে।

আর ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম একই হারে কমে ৭৮ ডলার ৪৬ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।

২৭ অক্টোবর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে ৮৫ দশমিক শূন্য ৭ ডলারে ওঠে। এরপর থেকেই তা কমতে থাকে। ৮ নভেম্বর এর দর ছিল ৮২ দশমিক ৫ ডলার। এক মাস আগে ১৬ অক্টোবর দাম ছিল ৮০ ডলার।

আর এক বছর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার। তেলের দামের এই পতন সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। কমার কারণ নিয়েও চলছে নানা বিশ্লেষণ। রয়টার্স জানিয়েছে, এটি সম্ভব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ চীন রেখেছে বলেই।

বাইডেন প্রশাসন তার মিত্রদের কাছে অনুরোধ করেছিল যাতে দেশগুলো তাদের সংরক্ষিত (রিজার্ভ) তেল বাজারে ছেড়ে দেয়। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে চীন এ কাজটিই করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন অনেক দিন ধরেই বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত। কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ও ট্রাম্পের পরাজয় সেই বাণিজ্য যুদ্ধ কিছুটা কমিয়ে রাখলেও একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি।

চীন যে যুক্তরাষ্ট্রের এই অনুরোধ রাখবে তা অনেকেই আশা করেননি, তবে চীনের এই সিদ্ধান্ত বাজারকে প্রভাবিত করেছে; কমছে তেলের দর। জ্বালানি তেলের দাম কমার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংকে ধন্যবাদ দিয়েছেন বিশ্ব জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিস্ট্যাড এনার্জির জ্যেষ্ঠ বাজার বিশ্লেষক বিজোরনার টনহাউজেন বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। দেশ দুটি সংরক্ষিত তেল বাজারে ছাড়ায় দাম কমতে শুরু করেছে।

টনহাউজেন বলেন, বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন ডিসেম্বরে ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আসতে পারে। এটা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে কিংবা আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার বৃহত্তর সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে, তবে সংরক্ষিত তেল ছাড়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য সামগ্রিক চিত্র পরিবর্তন না-ও হতে পারে।

ইউরোপে করোনা মহামারির চতুর্থ ঢেউ শুরু হওয়ায় নতুন করে আতঙ্ক দেখা দেয়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার আরেকটি কারণ বলে জানিয়েছে রয়টার্স। কয়েক দিন আগে জো বাইডেন ও শি চিনপিংয়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা হয়।

বিশেষ করে বাইডেন সংরক্ষিত তেল বাজারে ছাড়তে চীনের প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানান। এর পরই দেশ দুটির সমন্বিত পদক্ষেপের পর লাখো ব্যারেল তেল বাজারে আসে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে কেবল চীনকেই সংরক্ষিত রাখা তেলের ব্যবহার বাড়াতে বলেছে তা নয়,

একই অনুরোধ করা হয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের মতো বৃহৎ তেল ব্যবহারকারী দেশগুলোকেও। এর মধ্যে শুরুতেই চীন অনুরোধ রক্ষা করেছে। তেলের দর গত অক্টোবর থেকে বেশি বাড়া শুরু করেছিল মূলত তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের এক সিদ্ধান্তে।

তারা আগের লোকসান তুলে আনতে জ্বালানি তেলের উত্তোলন কমিয়ে দেয়। বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে থাকায় বাড়ছিল তেলের চাহিদা। আবার কোভিড সংক্রমণের সময় সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এমনিতেই বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চিন্তিত মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ে। এ রকম সময়ে চাহিদা বৃদ্ধি ও জোগান কমে যাওয়ায় জ্বালানি তেলের দর ব্যারেলপ্রতি ৮৫ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০১৪ সালের পর ওটাই ছিল সর্বোচ্চ দর। প্রতিটি দেশই আপৎকালীন সময়ের জন্য জ্বালানি তেল একটি সংরক্ষিত অবস্থায় রাখে।

মূলত এটি শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে, যখন আরব দেশগুলো তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এরপর এ ধরনের অবস্থা হয়েছিল ২০১১ সালে, যখন ওপেক সদস্য লিবিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র যে কেবল চীনকেই সংরক্ষণে রাখা তেলের ব্যবহার বাড়াতে বলেছে তাই নয়,

একই অনুরোধ করা হয়েছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের মতো বৃহৎ তেল ব্যবহারকারী দেশগুলোকে। এর মধ্যে শুরুতেই চীন অনুরোধ রক্ষা করায় তা ওপেককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। কেননা বিশ্বের শীর্ষ তেল ব্যবহারকারী দেশ চীন।

যদিও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ওপেক এ নিয়ে কিছু বলেনি, তবে তারা যে বিস্মিত, তা জানিয়েছে রয়টার্স। ওপেকের সদস্য এখন ১৫টি দেশ। তাদের মিত্র রাশিয়া।

এই দুই মিলে তাদের বলা হয় ওপেক প্লাস। এই ওপেক প্লাসের একটি সূত্রের কথা উল্লেখ করে রয়টার্স জানায়, তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের দরকার ছিল না।

কেননা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কোভিড সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে এমনিতেই তেলের চাহিদা আবার কমে যাবে এবং দামও কমবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তেলের দর আরও বাড়বে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা থেকে বিশ্ব কিছুটা দূরে সরে যাচ্ছে।