সীতাকুণ্ডে ১৬ লাশের দাবিদার ২০ জন

সীতাকুণ্ডে বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে ছবি হাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী।

ফাইজা রহমান। বয়স মাত্র সাত মাস। এখনও পুরোপুরি বাবাকে চেনা হয়নি তার। ঠিক মতো ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকতেও পারে না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। প্রিয় বাবার লাশ চিহ্নিত করতে গতকাল তাকেই দিতে হলো নমুনা! প্রিয়তম স্বামীর লাশও এখন আর চিনতে পারছেন না স্ত্রী। নিখোঁজ স্বামীকে খুঁজে পেতে গত দু’দিন অনেক জায়গায় ধরনা দিয়েছেন রেশমা বেগম। হতাশ হয়ে স্বামীর লাশ পেতে গতকাল সোমবার চমেক হাসপাতালে নিজের রক্তের নমুনা দিয়েছেন তিনি। শুধু ফাইজা কিংবা রেশমা বেগম নন; প্রিয়জনের খোঁজে এভাবে রক্তের নমুনা জমা দিয়েছেন আরও অনেকেই। চমেক হাসপাতালে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া এমন অজ্ঞাত লাশ আছে ১৬টি। কিন্তু ২০ জনের স্বজন তাঁদের লাশ দাবি করে নমুনা দিয়েছেন। ফলে নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ৩৫ জনের শরীর থেকে। নিখোঁজ চার ব্যক্তির স্বজনও দিয়েছেন নমুনা। এক পরিবারের একাধিক সদস্যের কাছ থেকেও নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডির ঢাকা থেকে আসা ফরেনসিক বিভাগ। সিআইডি চট্টগ্রামের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. শাহনেওয়াজ খালিদ সমকালকে বলেন, ‘এক লাশের দাবিদার কয়েকজন। তাই আমরা নিহতদের পরিবারের একাধিক সদস্যের কাছ থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করছি। এখনও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি ১৬ জনের। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ দল সোমবার ২০টি লাশের দাবিতে ৩৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছে। তবে এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যাঁরা নমুনা দিয়েছেন, তাঁদের নমুনার ডিএনএ প্রোফাইলিং করতে আমাদের তিন থেকে চার দিন সময় লাগবে। কিন্তু মরদেহের যে নমুনা, সেগুলোর প্রোফাইলিং করতে অন্তত এক মাস সময় লাগবে। যেসব লাশের পরিচয় মেলেনি, সেসব লাশের সঙ্গে এসব ডিএনএ মিলিয়ে পরিচয় শনাক্ত করা হবে।’ সোমবার পরিচয় শনাক্ত হওয়া ২২ জনের লাশ তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার তথ্য সমকালকে জানায় জেলা প্রশাসন।

বাবাকে ফিরে পেতে নমুনা দিল ৭ মাসের ফাইজা
দু’দিনেও মেলেনি প্রিয় বাবার লাশ। তাই বাবার লাশটি ফিরে পেতে চমেক হাসপাতালে ছুটে এলো সাত মাসের মেয়ে ফাইজা রহমান। সীতাকুণ্ডের ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণের ঘটনায় গত শনিবার রাতে নিখোঁজ হন ফাইজার বাবা আবদুস সোবহান। ৯ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। চমেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের সামনে গতকাল সোমবার তার বাবাকে শনাক্ত করতে ফাইজারের মুখের লালা নেন সিআইডির সদস্যরা। এ সময় দুই চোখ বেয়ে জল পড়তে দেখা গেছে পাশে দাঁড়ানো আবদুস সোবহানের স্ত্রী ইস্পাহান সুলতানার। নিখোঁজ সোবহানের লাশটি খুঁজে পেতে মেয়ের পাশাপাশি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে সোবহানের বোনেরও। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও কান্নারত অবস্থায় ইস্পাহান সুলতানা বলেন, ‘দুই দিন ধরে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে হন্যে হয়ে স্বামীর লাশ খুঁজছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। আল্লাহ আমাকে এত বড় শাস্তি কেন দিল?’ শনিবার রাতে ডিপোতে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান আবদুস সোবহান। স্ত্রী ইস্পাহানকে ভিডিও কল দিয়ে আগুনের ভয়াবহতা দেখাচ্ছিলেন তিনি। স্ত্রী তখন আগুনের কাছ থেকে তাঁকে দূরে সরে যেতে বারবার তাগাদা দেন। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান ইস্পাহান। লাশ ফিরে পেতে হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন সোবহানের ভাই রায়হান উদ্দিনও। তাঁদের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শেখেরখীল এলাকায়। মাত্র আড়াই বছর আগে বিয়ে করেন সোবহান।

মাঈনুদ্দীনের খোঁজ পেতে ব্যানার হাতে হতভাগা বাবা
‘আমরা কিছুই চাই না; মাঈনুদ্দীনের লাশটি পেলেই হবে’- এভাবেই বলতে থাকেন দু’দিন ধরে নিখোঁজ থাকা কাভার্ডভ্যান চালক মো. মাঈনুদ্দীনের বাবা হেমায়েত উল্লাহ। মাঈনুদ্দীনের ছবি ও যে গাড়িটি তিনি চালাতেন, তার একটি ছবি সংবলিত পোস্টার হাতে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ আশপাশের হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছোটাছুটি করতে থাকেন হতভাগা এই বাবা। চট্ট মেট্রো-ট-১২০৮৮৫ নম্বরের এই কাভার্ডভ্যানটি চার বছর ধরে চালাচ্ছিলেন মাঈনুদ্দীন। ঘটনার সময়ও ডিপোর ভেতরে গাড়িতে ছিলেন তিনি। এ সময় আগুনে পুরোপুরি পুড়ে যায় গাড়িটি। এরপর থেকে আর হদিস মেলেনি মাঈনুদ্দীনের। তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার বয়ারচরে।

ভাইয়ের লাশ পেতে নমুনা
‘ভাই, এখানে আগুন লেগেছে’- ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে এভাবে আগুন লাগার খবর ভাই ও মাকে ফোনে বলেন নিখোঁজ মাহবুব ইসলাম। তিনি ওই ডিপোর সিকিউরিটি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার সময় ডিপোর ভেতরেই দায়িত্বরত অবস্থায় ছিলেন মাহবুব। ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ার পর তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দেন ভাই। রাত ৩টা পর্যন্ত মাহবুবের ফোনে রিং বাজলেও তা রিসিভ করেননি তিনি। এরপর গত দু’দিন ধরে চমেক হাসপাতালের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে মাহবুবের খোঁজ পেতে ছুটছেন তাঁরা। কিন্তু কোথাও মিলছে না কোনো খবর। নমুনা দিয়ে হলেও প্রিয় ভাইয়ের লাশটি খুঁজে পেতে চায় পরিবার।

স্বামীর লাশ চিনতে পারছেন না স্ত্রী
তিন মাসের কোলের বাচ্চাকে নিয়ে চমেক হাসপাতালে হাজির হন রেশমা বেগম। বিএম ডিপোতে বিস্টেম্ফারণের পর থেকে আর খোঁজ মিলছে না স্বামী শাহজাহানের। সোমবার সন্তানকে কোলে নিয়েই নিজের নমুনা দিয়েছেন রেশমা। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বাবা মোহাম্মদ লিটন।

নমুনা দিলেন বৃদ্ধ মা-বাবা
ছেলে মো. ফরিদুজ্জামান ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরি পাওয়ায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের মিঠাপুরের বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম ও মোছাম্মৎ ফুলমতি বেগম দম্পতির ঘরে। কিন্তু ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ সবকিছুই তছনছ করে দিয়েছে তাঁদের। প্রিয় সন্তানের খোঁজ পেতে এখন পাগলপ্রায় ফরিদুজ্জামানের বৃদ্ধ মা-বাবা। শত কষ্টের পরও ছেলের খোঁজ পেতে ছুটে আসেন হাসপাতালে। মা-বাবা দু’জনই দিয়েছেন নমুনাও।

হস্তান্তরিত মরদেহ :পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর যাঁদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে- কুমিল্লার নাঙ্গলকোট এলাকার মো. মনিরুজ্জামান, ভোলার দক্ষিণ বালিয়ারা এলাকার হাবিবুর রহমান, প্রাণ গ্রুপের কর্মচারী রবিউল আলম, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার মুমিনুল হক, নাজিম উদ্দিন রুবেল ও মহিউদ্দিন, সীতাকুণ্ডের আফজাল হোসেন, নোয়াখালীর মো. সুমন, যশোরের ইব্রাহিম হোসেন, বিএম ডিপোর ডেস্ক এক্সিকিউটিভ শাহাদাত উল্লাহ মজুমদার, সন্দ্বীপের তৌহিদুল ইসলাম, ফেনী সদরের সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, রাঙামাটির মিটু দেওয়ান, পিরোজপুরের মো. সোহেল, মঠবাড়িয়ার মো. ফারুক, শেরপুরের রমজানুল ইসলাম, খুলনার বটিয়াঘাটার শাকিল তরফদার, রাঙমাটির রিপন চাকমা, মানিকগঞ্জের রানা মিয়া, নোয়াখালীর সুধারামের মো. সুমন, চাটখিলের বানসা এলাকার মো. আলাউদ্দিন, চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার মো. হারুন, মিরসরাইয়ের শাহাদাত হোসেন ও রমজান আলীম এবং মৌলভীবাজারের মো. নয়ন।

এখনও নিখোঁজ ৪ ফায়ার ফাইটার :এখনও ফায়ার সার্ভিসের চার কর্মী নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁরা হলেন- মো. রবিউল ইসলাম, ফরিদুজ্জামান, শফিউল ইসলাম এবং এমরান হোসেন। এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নিখোঁজদের শনাক্ত করতে সোমবার কয়েকজনের পরিবারের একাধিক সদস্যের কাছ থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।