দলের কাছে প্রশ্ন রেখে রওশন ফের ব্যাংককে, বিদায় জানালেন জি এম কাদের

জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) চিফ প্যাট্রন রওশন এরশাদ আট দিন দেশে থাকার পর আবারও থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে গেছেন। সেখানে তিনি বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তিনি ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। সঙ্গে গেছেন পুত্র রাহ্গির আল মাহি (সাদ) এরশাদ এমপি ও তার স্ত্রী মাহিমা এরশাদ।

জাপার দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এমপি ও মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি সোমবার রাতে ওয়েস্টিনে গিয়ে রওশনের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে রাঙ্গা ইত্তেফাককে বলেন, ‘জাপার রাজনীতি, আগামী নির্বাচন ও দেশের সামগ্রিক বিষয়ে ম্যাডামের সঙ্গে কথা হয়েছে।’ অন্যদিকে, সোমবার ওয়েস্টিনে রওশনকে দেখতে গেছেন এরশাদ-বিদিশার ছেলে এরিক। এ সময় এরিকের লেখাপড়া ও গানের বিষয়ে খোঁজ নেন রওশন। আর এরিক তাকে দলের নেতৃত্ব নেওয়ার অনুরোধ করে বলেছেন, ‘আপনি নেতৃত্ব না নিলে জাপা টিকে থাকবে না।’

উল্লেখ্য, প্রায় আট মাস বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সংসদ অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে গত ২৭ জুন দেশে ফিরেন রওশন এরশাদ। দেশে ফিরে গুলশানের বাসায় না গিয়ে বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি ওঠেন গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে। দেশে অবস্থানকালে গত ২৯ জুন সংসদের বাজেট অধিবেশনে যোগ দেন রওশন। নির্ধারিত আসনের বদলে হুইল চেয়ারে বসেই ঐ দিন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্য রাখেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে রওশন সংসদে দেওয়া তার বক্তব্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ, সিলেট-সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যায় ত্রাণ তৎপরতা ও ময়মনসিংহ বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রশংসা করেন।

যাপায় বিভক্তি দেখে গেলেন রওশন

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে রওশন দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে তাকে নেতাকর্মীদের বিপুল সম্বর্ধনার মধ্যেই যাপায় আবারও বিভক্তি-রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দলটির ভেতরে ‘রওশনপম্হি’ ও ‘জি এম কাদেরপন্থি’ হিসেবে অঘোষিতভাবে দুটি বলয়ের মধ্যে শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিক এক খেলা। গত ২ জুলাই রওশন দলের নেতাদের নিয়ে ওয়েস্টিন হোটেলে জাপার ব্যানারে ‘মতবিনিময় সভা’ ডাকলেও কেউ সাড়া দেননি। প্রেসিডিয়ামের সব সদস্য, দলীয় সংসদ সদস্য ও দলের সাবেক সংসদ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানালেও প্রেসিডিয়ামের দুই জন সদস্য ছাড়া আর কেউ রওশনের সেই সভায় যাননি, দলের এমপিরাও কেউ যাননি। বরং রওশন যখন মতবিনিময় সভা করছিলেন, তখন জি এম কাদেরসহ দলটির নেতা-এমপিদের বেশির ভাগই অবস্হান করছিলেন বনানী কার্যালয়ে।

রওশনের মতবিনিময় সভায় জাপার প্রেসিডিয়ামের দুই সদস্য হাবিবুর রহমান হবি ও কারি হাবিবুল্লাহ বেলালী উপস্থিত ছিলেন। সংসদ সদস্যদের মধ্যে শুধু রওশনপুত্র সাদ এরশাদ ছিলেন। দলের এই দুই জন প্রেসিডিয়াম সদস্যের বিষয়ে চুন্নু ইত্তেফাককে জানান, পরবর্তীতে তারা দুই জনই পার্টির চেয়ারম্যানকে এসে জানিয়েছেন যে —তারা বিষয়টি বুঝতে পারেননি, তারা ভেবেছিলেন প্রেসিডিয়ামের সবাই যাবেন, তাই তারা নিজের মতো চলে গিয়েছিলেন ঐ অনুষ্ঠানে। এজন্য তারা পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

এতদিন ওয়েস্টিনে না গেলেও জি এম কাদের গতকাল বিমানবন্দরে রওশনকে বিদায় জানিয়েছেন। জি এম কাদের ছাড়াও রওশনকে বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন জাপার কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম, সংসদের চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, ফখরুল ইমাম, শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও মীর আবদুস সবুর আসুদ এবং দলীয় সংসদ সদস্য শেরীফা কাদের, নাসরিন জাহান রতনা, অধ্যাপিকা রওশন আরা মান্নান, লিয়াকত হোসেন খোকা, নাজমা আক্তার ও আহসান আদিলুর রহমান প্রমুখ।

হোটেলের বিল পরিশোধ করল কে

সোমবার রাতে ওয়েস্টিনে গিয়ে দেখা যায়, রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ হোটেলের বিল কাউন্টারে বিল নিয়ে কথা বলছেন। এ সময় কাউন্টার থেকে তাকে স্যুটসহ চারটি কক্ষের পৃথক বিলের কপি দেওয়া হয়। তাতে রওশনের কক্ষের মোট বিল আসে ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা। আর তিনটি কক্ষের প্রতিটির ভাড়া বাবদ আসে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে। এর বাইরে খাওয়া ও আনুষঙ্গিক মিলিয়ে মোট বিল আসে প্রায় সাত লাখ টাকা। বিল কাউন্টার থেকে গোলাম মসিহকে জানানো হয়, বিলে ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছে, আর অগ্রিম জমা ছিল ৪ লাখ টাকা। রওশনের ঘনিষ্ঠজনরা ও জাপার দায়িত্বশীল নেতারা ইত্তেফাককে জানান, হোটেলের সমুদয় বিল পরিশোধ করেছেন ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্ট’-এর চেয়ারম্যান ও জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশিদ, যিনি একজন ব্যবসায়ী এবং বি. বাড়িয়ার নবীনগরে আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। যদিও বিলের বিষয়ে গোলাম মসিহ ইত্তেফাককে জানান, রওশন এরশাদ নিজেই বিল পরিশোধ করেছেন।