নতুন নেতার অধীনে কেমন হবে শ্রীলঙ্কা

 

শ্রীলঙ্কার ছয়বারের প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে গতকাল বুধবার দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ভঙ্গুর অর্থনীতি ও সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশটিকে সংকট থেকে প্রেসিডেন্ট রনিল কীভাবে উদ্ধার করেন, তাই এখন দেখার অপেক্ষায় অনেকে। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর দেওয়া বক্তব্যে রনিল বিক্রমাসিংহে সব রাজনৈতিক পক্ষকে মতভেদ ভুলে দেশকে সংকট থেকে বের করে আনতে তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

 

বর্তমানে শ্রীলঙ্কার অবস্থা কতটা নাজুক, তার একটা চিত্র পাওয়া যেতে পারে জাতিসংঘ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুসারে, দেশটির প্রতি ছয় পরিবারের মধ্যে পাঁচ পরিবারের লোকজন প্রয়োজনের চেয়ে কম খাবার খাচ্ছে। এ ছাড়া বৃহৎ পরিসরে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে স্কুল ও কম প্রয়োজনীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। সরকারের কাছে বিদ্যুৎ কেনার অর্থ নেই। তেল আমদানি করতে না পেরে দীর্ঘ লোডশেডিং সহ্য করছে শ্রীলঙ্কান জনগণ। পেট্রোল ও ডিজেলের জন্য পাম্পে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছেন গাড়িচালকরা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ম্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মূল ভিত্তি- পর্যটন ও বিদেশি রেমিট্যান্স। করোনা মহামারি ও আগের সরকারের গৃহীত নীতিগত ভুলের কারণে এই দুটি ভিত্তিও ভয়ংকর রকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর গোটাবায়া রাজাপাকসে কৃষি কাজে ব্যবহূত রাসায়নিক আমদানি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এতে চলতি বছর দেশের অর্ধেকেরও বেশি ফসল নষ্ট হয়েছে। অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে ছয় মাস পর রাসায়নিক আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও এখন পর্যন্ত দেশটিতে সারের আকাল চলছে। গত এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা যখন নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, তখন সরকারের ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ ছিল।

পেশায় আইনজীবী রনিল ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন; কিন্তু মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। এই পদে পরের তিন দশকে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা ইউএনপির এই রাজনীতিক ক্ষমতায়, এমনকি বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালেও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ভালো বোঝাপড়া ও দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি পশ্চিমাপন্থি সংস্কারক হিসেবে বেশ পরিচিত। এরই মধ্যে বিক্রমাসিংহে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। এ ছাড়া জাপান, চীন এবং ভারতের দ্বিপক্ষীয় সহায়তার ওপর জোর দিচ্ছেন, যাতে তাঁকে আরেকটি অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে না হয়।

 

আইএমএফের সঙ্গে একটি চুক্তি করার আগেই বিক্রমাসিংহে নতুন বাজেট প্রস্তাব করতে চান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, গত বছরের প্রস্তাবিত বাজেট খুবই বিভ্রান্তিকর ছিল। ওই বাজেটে ঋণের পরিসংখ্যান কমিয়ে দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি তিনি জরুরি আর্থিক সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। কৃচ্ছ্র সাধনের জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের মতো লোকসানে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলেছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারসহ দুই বিলিয়নেরও বেশি ঋণ করেছে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্স।

 

 

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য সত্ত্বেও চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে উদ্ধারে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। যদিও কিছু রাজনীতিবিদ ভর্তুকি কমাতে এবং কর বাড়াতে আইএমএফের দেওয়া কঠোর ‘প্রেসক্রিপশনের’ তীব্র বিরোধিতা করেছেন; কিন্তু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা একমত যে, আন্তর্জাতিক ঋণদাতার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার এই চুক্তি করা উচিত। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলেরই স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, যারা আইএমএফের সঙ্গে এই চুক্তি ভেস্তে দিতে পারে।এ ছাড়া আশা করা হচ্ছে, বিক্রমাসিংহে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন, যিনি তার মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করবেন এবং দেশকে নতুন সংস্কারের মধ্যে নিয়ে আসবেন।

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, এতসব পদক্ষেপও বিক্রমাসিংহের টিকে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভ এবং এই মাসের শুরুতে রাজাপাকসেকে তাঁর প্রাসাদ থেকে বহিস্কারের চূড়ান্ত পরিণতি বিক্রমাসিংহের জন্যও সমস্যা তৈরি করতে পারে। বিক্ষোভকারীরা রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয়। অনেকে বিশ্বাস করেন, ২০১৫ সালে রাজাপাকসে পরিবার যখন ক্ষমতা হারিয়েছিল, সে মময় তাদের সাহায্য করেছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে। আর এবার গোটাবায়া রাজাপাকসে নিজের ক্ষমতা বাঁচানোর চেষ্ট