করোনা টিকা চতুর্থ ডোজ নেওয়ার হিড়িক

 

দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজের কার্যক্রম কার্যত ঝিমিয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজে স্বীকার করেছেন, সরকার বিনামূল্যের বুস্টার ডোজের দোকান খুলে বসে থাকলেও ক্রেতা নেই। সাধারণ মানুষকে তৃতীয় ডোজ দিতে যেখানে গলদঘর্ম অবস্থা, সেখানে প্রভাব খাটিয়ে চতুর্থ ডোজ নেওয়ার হিড়িক পড়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর চার থেকে পাঁচটি সরকারি হাসপাতালের পরিচালক ও উপপরিচালককে ‘ম্যানেজ’ করে সাবেক-বর্তমান মন্ত্রী-এমপি, সচিব, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাঁদের কয়েক হাজার স্বজন গোপনে চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, বুস্টার ডোজের জন্য বরাদ্দ ফাইজারের টিকা দিয়েই এপ্রিল-মে মাসে গোপনে চতুর্থ ডোজের কার্যক্রম শুরু হয়। এখন প্রতিদিনই প্রভাবশালীরা টিকাকেন্দ্রে হাজির হচ্ছেন। বাধ্য হয়ে তাঁদের টিকা দিচ্ছেন কর্মীরা। যদিও এই টিকা দেওয়ার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখনও অনুমোদন দেয়নি। ইসরায়েলসহ কয়েকটি দেশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ষাটোর্ধ্বদের দিলেও বাংলাদেশে সরকারের তরফে এমন কোনো ঘোষণা আসেনি। ফলে টিকা নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নজরে এলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

সম্প্রতি রাজবাড়ী-২ আসনের (বালিয়াকান্দি-পাংশা-কালুখালী) এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জিলল্গুল হাকিম নির্বাচনী এলাকা থেকে চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন। সমকালের কাছে তিনি বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গত বছর ডিসেম্বরে জিল্লুল হাকিম টিকার তৃতীয় ডোজ নেন। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হন। সুস্থ হওয়ার চার মাস পর ৬৮ বছর বয়সী এই এমপি চতুর্থ ডোজ নেন।

জিল্লুল হাকিম বলেন, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার জন্যই চতুর্থ ডোজ নিয়েছি। তাঁর মতো অনেক এমপি চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

রাজধানীর একাধিক টিকাকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর চার থেকে পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে এসে বুস্টারের চার থেকে ছয় মাস পার হয়েছে- এমন ব্যক্তি গোপনে চতুর্থ ডোজ নিচ্ছেন। তবে এসব টিকাগ্রহীতার জন্য আলাদা কোনো তালিকা করা হচ্ছে না। তৃতীয় ডোজের মধ্যে যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখান পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালের উপপরিচালক সমকালকে বলেন, গত বছর ডিসেম্বরে দেশে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়। গবেষণার তথ্যমতে, বুস্টার গ্রহণকারী অনেকের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি এখন হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এ জন্য নিজ উদ্যোগে অনেকে চতুর্থ ডোজ নিতে আসছেন। এই ডোজ নিতে আসাদের মধ্যে সাধারণ মানুষ নেই বললেই চলে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি ঘোষণা না থাকায় চতুর্থ ডোজ গ্রহণকারীদের আলাদা তালিকা করা হচ্ছে না। তাঁদের বুস্টার ডোজ টিকার ক্যাম্পেইনে যুক্ত করা হচ্ছে।

রাজধানীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রের সমন্বয়ক সমকালকে বলেন, এপ্রিল-মে মাসে গোপনে চতুর্থ ডোজ শুরু হলেও এখন অনেকটা প্রকাশ্যে দেওয়া হচ্ছে। একজন মন্ত্রী-এমপি সরাসরি কেন্দ্রে এসে হাসপাতাল পরিচালক ও উপপরিচালকের রেফারেন্স দিয়ে চতুর্থ ডোজ নিতে চাইলে আমাদের আসলে কিছুই করার থাকে না। প্রতিদিনই মন্ত্রী-এমপি ও তাঁদের স্বজনদের এই আবদার মেটাতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের

 

সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নৈতিকভাবে এখন চতুর্থ ডোজ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশের সব নাগরিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ নিশ্চিতের পরই কেবল এটি হতে পারে। মূলত টিকা নিয়ে অব্যবস্থাপনার কারণেই প্রভাবশালীরা চতুর্থ ডোজ নিতে পারছেন বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, চতুর্থ ডোজ দেওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশনা নেই। তবে বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী চতুর্থ ডোজ নিতে কেন্দ্রে এলে না করছি না। হাতে পর্যাপ্ত টিকা থাকায় এটি দেওয়া হচ্ছে। তবে তৃতীয় ডোজ নেওয়ার চার মাস পার হয়েছে কিনা, তা গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। তা ছাড়া কেউ টাকা দিয়ে নিতে চাইলে তা আমরা প্রচার করছি না; তাঁকে চতুর্থ ডোজ দেওয়া হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত শনিবার পর্যন্ত দেশে ১২ কোটি ৯৬ লাখ ৩৭ হাজার মানুষ প্রথম, ১২ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮২৪ জন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার পেয়েছেন ৩ কোটি ৪১ লাখ ৩৬ হাজার ৯ জন। এখন পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যার ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ প্রথম, ৭০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ দ্বিতীয় ও ২০ শতাংশ মানুষ তৃতীয় ডোজ পেয়েছেন।