১৫ আগস্টের পর মানবাধিকার কোথায় ছিল, প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না পাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজ অনেক জায়গায় মানবাধিকারের কথা বলা হয়। সরকারের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। ১৫ আগস্ট আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি, সেই সময়ে মানবাধিকার কোথায় ছিলো? আমি মা-বাবা হারিয়েছি, বিচার চাইতে পারবো না, মামলা করতে পারবো না। আমরা মানুষ নই?’

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত- এমন অভিযোগ পুনরায় করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমান জড়িত না থাকলে খুনিদের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে সহযোগিতা এবং বিভিন্ন দূতাবাসে পুনর্বাসন করতেন না। তিনি খুনি ও ষড়যন্ত্রকারী না হলে খুনি মোস্তাক তাকে সেনাপ্রধানই করবেন কেন? আর কেন খুনিদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন?

মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংকটের কারণে দীর্ঘ প্রায় তিন বছর পর স্বশরীরে উপস্থিত থেকে দলীয় কোনো কর্মসূচিতে উপস্থিত হন শেখ হাসিনা। দলীয় প্রধানের উপস্থিতির কারণে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরেও হাজার হাজার নেতাকর্মী হাত নেড়ে ও গগণবিদারী স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে দেখা যায়।

বাংলাদেশের র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা আজ স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেয়, সেই দেশই তো খুনিদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। তাদের কাছ থেকে আমাদের মানবাধিকারের ছবক শুনতে হয়। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।’

তিনি বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের নারী-শিশুদের হত্যা করেছে- তারাই মানবাধিকারের কথা বলে। আমার প্রশ্ন, আমাদের মানাবধিকার কোথায়? যারা খুনিদের লালন পালন করলো, যারা খুনি-মানবাধিকার লঙ্ঘন করলো, তাদের মানবাধিকার নিয়ে তারা ব্যস্ত। বিএনপি এদের লালনপালনকারী।’

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রবাসে নিজের ছয় বছরের নির্বাসন ও ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পরও দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে। দেশে ফিরে এসেও বিচার চাইতে পারিনি। ’৯৬-তে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে আদালতে গিয়েছি, বক্তব্য দিয়ে বিচার চেয়েছি। আমাদের মামলা করারও অধিকার ছিলো না। কারণ সেখানে ইনডেমনিটি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছে। খুনিদের রাজনৈতিক দল গঠন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সারাবিশ্বে এই হত্যার বিচারের জন্য জনমত চালিয়েছি। আামদের নিয়ে মিথ্যাচার অপপ্রচার করা হয়েছে। ৯৬ সালে ক্ষমতায় না এলে তো ইনডেমনিটি বাতিল করতে পারতাম না। বিচারের উদ্যোগও নিতে পারতাম না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসলে কখনো এই হত্যার বিচার হতো না।’

দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারসহ বিভিন্ন মহলের বাঁধা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও এই বিচারের রায় কার্যকরের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১৯৯৮ সালের ৬ নভেম্বর যেদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রায় হবে, সেদিনও হরতাল ডেকেছিল বিএনপি। যাতে বিচারক আদালতে যেতে না পারেন। কিন্তু সেদিন রায় হয়েছিলো।’

বক্তব্যের একপর্যায়ে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার নৃশংসতম ঘটনার কথা স্মরণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বেঁচে থাকাটা যে কতো কষ্টের!’

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইনডেমনিটি জারি করে এই হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করাসহ খুনিদের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় ও পুনর্বাসনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান নিজে উদ্যোগী হয়ে খুনিদের লিবিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে সহযোগিতা করেছিলেন। পাকিস্তানের ভুট্টোকে অনুরোধ করে তার মাধ্যমে লিবিয়ার গাদ্দাফির সঙ্গে আলোচনা করে এই খুনিদের সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। পরে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন।’

এ সময় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কথিত সুশীল বলে পরিচিত ব্যারিস্টার মইনুল বঙ্গবন্ধুর খুনি পাশা ও হুদাকে নিয়ে প্রগশ নামের রাজনৈতিক দল করেছিলেন। আর এরশাদ ক্ষমতায় এসে খুনি ফারুককে ফ্রিডম পার্টি করার সুযোগ দেন ও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করেন। আর খালেদা জিয়া আরেক ধাপ ওপরে। তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনে খুনি রশিদ-ফারুক-হুদাকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয়। খুনি রশিদকে বিনাভোটে সংসদে এনে বিরোধীদলের আসনে পর্যন্ত বসায়। এরা কী করে বলবে যে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’

এ সময় খুনিদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভূমিকা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়া খুনি ফারুক, রশীদ এবং হুদাকে নির্বাচনে প্রার্থী করেন। তাদের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতাও বানান খালেদা জিয়া। এটাকে কীভাবে তারা অস্বীকার করবে? কীভাবে বলবে- এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তারা জড়িত নন।’

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কেন আওয়ামী লীগের কোনো নেতা প্রতিবাদ করতে পারলেন না- এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা তো অনেককে ফোনও করেছিলেন। তখন কোথায় ছিলেন তারা? ১৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে ৩২ নম্বরে লাশগুলো তো পড়ে ছিল। একটি মানুষ ছিল না সাহস করে এগিয়ে আসার? একটি মানুষ ছিল না প্রতিবাদ করার? কেন করতে পারেনি?’

তিনি বলেন, ‘এত বড় সংগঠন, এত লোক! কেউ তো একটা কথা বলার সাহসও পাননি। কত স্লোগান। “বঙ্গবন্ধু তুমি আছো যেখানে আমরা আছি সেখানে”। অমুক তমুক অনেক স্লোগান, কোথায় ছিল সেই মানুষগুলো। বেঁচে থাকতে সবাই থাকে, মরে গেলে যে কেউ থাকে না এটাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই আমিও কিছু আশা করি না। সবাইকে হারিয়ে বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা যে কত যন্ত্রণার, যারা এভাবে বেঁচে আছেন তারাই শুধু জানেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৫ আগস্ট থেকে ১৬ আগস্ট ওই লাশ পড়ে থাকলো। ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে গেলো টুঙ্গীপাড়ায়। সেখানে মা-বাবার কবরের পাশে মাটি দিয়ে আসে। সেখানে মৌলভী সাহেব আপত্তি তুলে বলেছিলেন আমি গোসল দেবো, কাফন-দাফন দেবো। কিন্তু দেশের গরিব মানুষকে যে রিলিফের কাপড় তিনি দিয়েছিলেন, সেই কাপড়েই জাতির পিতাকে কাফন দেওয়া হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কিছুই নিয়ে যাননি, শুধু দিয়ে গেছেন। একটি দেশ, একটি জাতি ও পরিচয় দিয়ে গেছেন। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে উন্নয়নের পথে যাত্রা করিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে তিনি কিছুই নিয়ে যাননি।’

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকটের মুখে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করতে হয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আজকে একদিকে তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে, প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এটা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। আজকে উন্নত দেশেও একই অবস্থা। ইউরোপের কোনো কোনো দেশে আরও খারাপ পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে আমরা বাধ্য হয়েছি তেলের দাম বাড়াতে।’

তিনি বলেন, ‘আমি জানি এটা বাড়াতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। সেটা আমরা বুঝি। সেজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ৫০ লাখ পরিবারকে মাত্র ১৫ টাকায় চাল আমরা সরবরাহ করবো। আর এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিল কার্ড দেবো। যার মাধ্যম সাশ্রয়ী মূল্যে চাল-ডাল চিনি যার যেটা প্রয়োজন, সেটা তারা কিনতে পারবে।’

দেশের মানুষের মধ্যে যারা কষ্টে আছেন, তাদের পাশে দাঁড়াতে সমাজের বিত্তশালী এবং দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এখন বিশ্বব্যাপী মন্দাভাব ও অনেক জায়গায় দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের সবারই কিছু করণীয় আছে। বঙ্গবন্ধুর এই বাংলাদেশে দেশের কোনো মানুষ কষ্ট পাক- তা আমরা চাই না। তাই দেশের যারা বিত্তবান রয়েছেন, সবার প্রতি আহ্বান জানাই নিজ নিজ এলাকায় অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ান, সহযোগিতা করুন। সরকার থেকে সাধ্যমত চেষ্টা করা হচ্ছে। দলের নেতাকর্মীদেরও নির্দেশ দিয়েছি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে।’

দেশের মানুষের জন্য তার সরকার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ভুমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঘর উপহার দেওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি চাই, দেশের একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না। এই কারণে সরকার থেকে তাদের ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। ঘর পাওয়া এসব মানুষের মুখের হাসি তৃপ্তি দেয়।’

জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার বাবা আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করে এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। তাই সব যন্ত্রণা সহ্য করে নীলকণ্ঠী হয়ে অপেক্ষায় ছিলাম কখন ক্ষমতায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো। এই দেশকে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারলেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত প্রতিশোধ নিতে পারবো। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছি।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। আজ বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা আর কেউ থামাতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে পারে না, যাবে না।’