‘প্রকৃত’ বিরোধী দল হতে গিয়ে চাপে পড়েছে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের যখন সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনায় মুখর, সে সময়ে সরকার সমর্থক বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ তাঁকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে হঠাৎ সম্মেলন ‘ডাকলে’ চাপে পড়ে জাপা। তখনও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, দলের নিয়ন্ত্রণ জি এম কাদেরের হাতে। কিন্তু পরবর্তী দুই সপ্তাহের ঘটনাক্রমে জাপার সংকট আরও বেড়েছে।
তাঁকে সরিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে জাপার সংসদীয় দল ১ সেপ্টেম্বর স্পিকার ড. শিরীন শারমিনকে চিঠি দিলেও এখনও স্বীকৃতি মেলেনি। জাপা সূত্রের খবর, এতেই স্পষ্ট সরকারি সমর্থন রওশন এরশাদের দিকেই।
তা স্পষ্ট হতেই জাপার এমপিদের অবস্থানও বদল হতে শুরু হয়েছে। সংসদীয় দলের পক্ষে স্পিকারকে চিঠি দেওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গাই অবস্থান বদল করেছেন; চিঠির শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাল্টা চাপ সৃষ্টিতে তাঁকে গতকাল বুধবার দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন জি এম কাদের।
জাপা সূত্রের খবর, পক্ষ বদলে রওশন এরশাদকে সমর্থন করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা। তাই দলের পদ হারিয়েছেন। অন্য কোনো এমপি রওশন এরশাদকে সমর্থন করলে একই পরিণতি হবে। মসিউর রহমান রাঙ্গা আবারও সংসদীয় দলের সভা ডাকার কথা বলেছিলেন। জি এম কাদের ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের শঙ্কা, আবার সভা হলে অনেক এমপি মসিউর রহমান রাঙ্গার মতো অবস্থান বদলে রওশন এরশাদকে সমর্থন করতে পারেন।
জি এম কাদের বলেছেন, মসিউর রহমান রাঙ্গা সংবাদমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের জন্য অবমাননাকর। তাই সবার সিদ্ধান্তে তাঁকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদে মসিউর রহমান রাঙ্গা বহাল থাকবেন বলে জানিয়েছেন জি এম কাদের।
একসময় জাপার হয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা রক্ষা করতেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। এখন এ ভূমিকা পালন করেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া জি এম কাদেরের পাল্টা চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রংপুর-১ আসনের এমপি এবং দলের সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা সমকালকে বলেছেন, জি এম কাদের তাঁকে অগণতান্ত্রিকভাবে অব্যাহতি দিয়েছেন। রংপুরে জি এম কাদেরের সঙ্গে ‘দেখা’ হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বলেছেন, সংসদীয় দলের সভার আলোচ্যসূচিতে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়টি ছিল না। তারিখেও ভুল রয়েছে। এগুলো ঠিক করে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনে পুনরায় সভা আহ্বান করার কথা বলেন।
জি এম কাদের বলেছেন, ১ সেপ্টেম্বরের সংসদীয় দলের সভার কার্যবিবরণী মসিউর রহমান রাঙ্গারই লেখা। তখন তিনি কোনো প্রশ্ন তোলেননি কেন? হঠাৎ কেন প্রশ্ন তুলে দলের বিরুদ্ধে বলতে শুরু করেছেন?
প্রায় সব ইস্যুতে সরকারের সুরে কথা বলে গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা পাওয়া জাপা বছরখানেক ধরে বেসুরো। কয়েক মাস ধরে জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ‘গরম’ বক্তৃতা করছেন। অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্নীতি, সুশাসন, নির্বাচনসহ প্রায় ইস্যুতেই সরকারকে কাঠগড়ায় তুলছেন। সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীরও সমালোচনা করেন জি এম কাদের। এতে সরকারপ্রধান উষ্ফ্মা প্রকাশ করেন।
গত ১৯ আগস্ট বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেন জি এম কাদের। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পাশে বসেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো এ ছবিকে বিএনপি-জাপার কাছাকাছি আসার বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে জি এম কাদের সমকালকে বলেছেন, বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনীতি অর্থহীন।
তবে ওই বিয়ের অনুষ্ঠানের ১২ দিন পর বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় জাপায়। থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ চিঠি দিয়ে দলের সম্মেলন ‘ডাকেন’। নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ‘ঘোষণা’ করেন। আট মাস ব্যাংককে চিকিৎসা নিয়ে রওশন এরশাদ গত জুনে দেশে ফিরে সংসদ অধিবেশনে অংশ নেন। নিজের অনুসারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন- হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাপা ভুল পথে চলছে। প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার খবর নিলেও জি এম কাদেরসহ জাপার নেতারা তাঁর অসুস্থতার খবর নেননি।
সপ্তাহখানেক পর রওশন এরশাদ থাইল্যান্ডে ফিরে যান। তাঁকে সামনে রেখে জি এম কাদের জামানায় জাপা থেকে বাদ পড়া নেতাদের আর তৎপরতা দেখা যায়নি। কিন্তু জি এম কাদের সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনায় আগের তুলনায় মুখর হতেই আসে রওশন এরশাদের চিঠি। তাতে বলা হয়, সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল অর্জনের অংশীদার হতে পারেনি জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা। আগামী নির্বাচনে দল গোছাতে জাপাকে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। এ লক্ষ্যে সম্মেলন ‘ডাকেন’ রওশন এরশাদ।
বিরোধীদলীয় নেতা করা, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে জাপার মহাসচিব ও পাঁচ কো-চেয়ারম্যানকে যুগ্ম আহ্বায়ক পদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা সবাই রওশনের উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা নেই বলে জানান। পরে রওশন এরশাদ জাপার সাবেক ও বর্তমান ১৭ নেতাকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। দু’জন নিজেদের সম্পৃক্ততা না থাকার কথা জানিয়েছেন। বাকিরা এতে যুক্ত হয়েছেন।
জাপা সূত্রের খবর, স্পিকার ১৪ দিনেও বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে না সরানোর কারণে স্পষ্ট হয়ে গেছে, সরকারের সমর্থন জি এম কাদেরের পক্ষে নেই। তিনি সমকালকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার দেশে ছিলেন না। স্পিকার ফিরেছেন। আশা করছেন, জাপার সংসদীয় দলের চিঠি আমলে নিয়ে স্পিকার তাঁকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন।
জাপা সূত্রের খবর, প্রকৃত বিরোধী দল হওয়ার চেষ্টা করায় জি এম কাদেরের প্রতি সরকারের সমর্থন নেই। রওশন এরশাদেই আস্থা রেখেছে আওয়ামী লীগ। মসিউর রহমান রাঙ্গা সমকালকে বলেছেন, ‘জি এম কাদের গত কিছুদিন ধরে যেসব কথা বলছেন, তাতে তো সরকারের সঙ্গে দূরত্বই তৈরি হয়েছে।’
রওশন এরশাদের প্রতি সরকারের সমর্থন এবং জি এম কাদেরের দূরত্বে জাপার ওপর চাপ আরও বেড়েছে। রওশন এরশাদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসিহ সমকালকে বলেছেন, জাপার যাঁরা এমপি, তাঁরা রওশন এরশাদের কারণেই সংসদে যেতে পেরেছেন। আগামীতে এমপি হতে হলে রওশন এরশাদকেই লাগবে। জি এম কাদের কাউকে এমপি বানাতে পারবেন না। তিনি সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে কথা বলছেন, তা হয় না। তিনি বিএনপির মতো কথা বলছেন।