গুদামে ১৯ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য মজুত, তবু যেন স্বস্তিতে নেই সরকার। এখন ৯ লাখ টন চাল আমদানির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় চালাচ্ছে মরিয়া চেষ্টা। ব্যবসায়ীদের নেতিবাচক আচরণের কারণে চালের বাজারের অস্থিরতা কাটছে না বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়-সংশ্নিষ্টরা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে পর্যাপ্ত চাল আছে। জ্বালানি তেলের বাড়তি দরের কারণে চালের দাম কেজিতে ৪০ থেকে ৬০ পয়সা পর্যন্ত বাড়তে পারে। সেখানে দেশের বাজারে কারণ ছাড়াই কেজিতে ৮-১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার পুরো দায় ব্যবসায়ীদের।
তবে সরকারের দেওয়া দোষ এককভাবে নিতে রাজি নন ব্যবসায়ী নেতারা। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী সমকালকে বলেন, ‘চালের বাজার শুধু ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। এখন মধ্য পর্যায়ের অনেক ধান ব্যবসায়ী মজুত ব্যবসা করছেন। তাঁরাও এর জন্য দায়ী।’ তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি ভারতে আতপ চালে ২০ শতাংশ শুল্ক্ক বসানোর খবরে মধ্য ও বড় ব্যবসায়ীরা বাজারে ধান ছাড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন আমাদের অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। ধান ছাড়া চাল করব কী দিয়ে?’
এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘যাঁরা ধান মজুত করে রেখেছেন, তাঁদের দিকে নজর দিতে হবে; একই সঙ্গে আমদানি বাড়িয়ে ওএমএসে বেশি চাল ছাড়তে হবে। না হলে বাজার ঠিক রাখা কঠিন হবে।’
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সমকালকে বলেন, ‘একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিভিন্ন সুযোগে চালের বাজার অস্থির করে তোলেন। তখন খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী করেন পাইকারি ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের; অন্যদিকে মিল মালিকরা খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর দোষ চাপান।’
তিনি বলেন, ‘এ সমস্যা সমাধানে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তিন স্তরের দাম ঘোষণার ব্যবস্থা করা হবে, যাতে কেউ কাউকে দোষারোপ করতে না পারেন।’
খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, বুধবার ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে যে ৯ লাখ টন চাল আমদানির নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে; এতে আমদানি প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চালও অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে, গত শনিবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভার বৈঠকেও চাল ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করেন খাদ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ভোক্তাকে কষ্ট দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইলে পরিণাম ভালো হবে না। তাহলে আমাদের মতো খারাপ কেউ হবে না।’
তিন মাসে লাগছে ৯ লাখ টন চাল :সম্প্রতি দেশে বোরো সংগ্রহ শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরে আমন ধান ঘরে উঠতে শুরু করবে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর- এই তিন মাস বাজারে চালের দাম বাড়ার একটা প্রবণতা থাকে। ওই তিন মাসে ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও টিসিবির কার্ডের জন্য সরকারের গুদাম থেকে ৯ লাখ টনের ওপরে চাল বের হয়ে যাবে। এই ঘাটতি পূরণে আমদানিতে জোর দিচ্ছে সরকার।
খাদ্য অধিদপ্তর ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করেছে মন্ত্রণালয়। আরও ৩ লাখ ৭০ হাজার টন চাল আমদানির চেষ্টা চলছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল বুধবারের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারের হাতে এখন মজুত আছে ১৮ লাখ ৮৩ হাজার টন খাদ্যশস্য। এর মধ্যে চাল আছে ১৭ লাখ ৮০ হাজার টন। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বোরোর ফলন কম হয়েছে। আমনের ফলনেও আশানুরূপ চাল পাওয়া যাবে না। এমনটা ধরে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাল আমদানিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে ৯ লাখ টন চাল আমদানির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে আমদানির চুক্তি করা চালের দাম নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সমকালকে বলেন, ‘যে দামে চাল কিনছি, এর চেয়ে কম দামে কেউ চাল কিনে দেখান। আমরা জনগণের সেবক, এখানে নয়ছয় করতে আসিনি।’
তিন দেশ থেকে আসছে চাল :ভিয়েতনাম থেকে জিটুজি পদ্ধতিতে ২ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির চুক্তি করেছে সরকার। এর মধ্যে ২ লাখ টন সেদ্ধ চাল আর ৩০ হাজার টন আতপ। ভিয়েতনাম ওই ২ লাখ টন সেদ্ধ চাল থাইল্যান্ড থেকে কিনে বাংলাদেশে সরবরাহ করবে। সেদ্ধ চাল কেনার চুক্তির সময় প্রতি টন চালের এফওবি দর ছিল ৪১৭ ডলার। এর সঙ্গে অন্য খরচসহ (জাহাজ ভাড়া, বার্থ অপারেটিং হ্যান্ডলিং, লাইটেনিং, বীমা ও মুনাফা) প্রতি টন চালের জন্য সরকার পরিশোধ করবে ৫২১ ডলার। অর্থাৎ, প্রতি টনে অন্য খরচ পড়ছে ১০৪ ডলার। ভিয়েতনাম থেকে চাল বাংলাদেশের গুদামে পৌঁছে দেবে সাউদার্ন ফুড করপোরেশন (ভিনা-২)।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রের দাবি অনুযায়ী, ভিয়েতনাম থেকে কেনা চালের বর্তমান এফওবি দর ৪৩২ ডলার, অর্থাৎ সরকার প্রতি টন চাল ১৫ ডলার কমে কিনতে পেরেছে। অন্যদিকে, ভিয়েতনামের চুক্তি করা ৩০ হাজার টন আতপ চালের প্রতি টনের এফওবি দর ছিল ৩৮৫ ডলার। এটির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিবর্তিত রয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহল বলছে, সরকার এফওবি দর নিয়ে যে তথ্য দিচ্ছে তাতে সমস্যা নেই। তবে ভিয়েতনামের চালের পরিবহন খরচ অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এটা খুবই পরিস্কার বিষয়। বেসরকারিভাবে যারা বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে তাদের সঙ্গে যাচাই করে দেখুন। যদি আমাদের চালের পরিবহন খরচ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেটাও লিখুন। আমরা কোনো লুকোচুরি করছি না।’ সরাসরি কিনতে না পেরে ভিয়েতনামের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের চাল কেনা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি সরাসরি কিনতে। তারা যেভাবে সাড়া দিয়েছে তাতে অনেক সময় লাগবে। এর পরও আমরা থাইল্যান্ড থেকে চাল কেনার চেষ্টায় আছি।’
এবারের চাল আমদানিতে সবচেয়ে বেশি দাম নিচ্ছে ভিয়েতনাম। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সূত্রের দাবি, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো চাল সরবরাহ করে না। তারা শুধু চাল দিতেই দেরি করে না, অনেক সময় গছিয়ে দেয় নিম্নমানের চাল, সেই চাল ফেরত পাঠাতে গিয়েও ঝামেলা দেখা দেয়। তাই একটি দেশের ওপর বেশি নির্ভরতা রাখতে চায় না খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ভারতীয় নাফেদ, এনসিসিএফের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে চাল আমদানি করতে গিয়ে সমস্যা হয়েছে। এসব অভিজ্ঞতার কারণেই সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আনার চেষ্টা করে।
এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিবহন খরচ সহজেই যাচাই করা সম্ভব। আপনি দেখান কেউ আমাদের চেয়ে কম খরচে চাল এনে দিতে পারে কিনা। তাহলে আমরা তার কাছ থেকেই নেব।’
মিয়ানমারের সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতিতে ২ লাখ টন আতপ চাল কেনার চুক্তির দিন, অর্থাৎ ২৯ আগস্ট ওই চালের এফওবি দর ছিল প্রতি টন ৩৮৯ ডলার। এই চাল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের গুদামে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার রাইস ফেডারেশনকে সরকারের পরিশোধ করতে হবে প্রতি টনে ৪৬৫ ডলার। মিয়ানমার থেকে যে চাল সরকার কিনেছে সেটার বাজারদর এখন প্রতি টনে ৫ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯৪ ডলার।
ভারত থেকে ২ লাখ টন সেদ্ধ চাল আনার চেষ্টা করলেও আপাতত ১ লাখ টন চাল আসছে বলে জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ভারতের ‘কেন্দ্রীয় ভান্ডার’ থেকে এ চাল কেনার সময় গত ১৯ আগস্ট এফওবি দর ছিল ৩৬৯ ডলার। এ দামেই ২৩ আগস্ট চুক্তি করে সরকার। এর মধ্যে ৭০ হাজার টন চাল আসবে নৌপথে (চট্টগ্রাম বন্দরে ৬০ শতাংশ, মোংলা বন্দরে ৪০ শতাংশ) এবং ৩০ হাজার টন চাল আসবে ট্রেনে। জাহাজে প্রতি টন চালের পরিবহনসহ অন্য খরচ ধরা হয়েছে ৭৪ ডলার। অর্থাৎ জাহাজে ভারত থেকে আসা প্রতি টন চালের দর পড়বে ৪৪৩ ডলার। অন্যদিকে, সব খরচ মিলিয়ে ট্রেনে প্রতি টন চালের ব্যয় দাঁড়াবে ৪২৮ ডলার।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ভারতের ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল কো-অপারেটিভ মার্কেটিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের (নাফেদ) কাছ থেকে ১ লাখ টন চাল আমদানির বৈঠক হয় গত ২৫ আগস্ট। বৈঠকে নাফেদ প্রতি টন চালের পরিবহনসহ অন্য খরচ ধরে প্রস্তাব দেয় ৪৬৫ ডলার। তবে এরই মধ্যে ভারত থেকে রেলপথে ৪২৮ এবং নৌপথে ৪৪৩ ডলারে চাল আমদানির চুক্তি হওয়ায় নাফেদের কাছ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া ভারত থেকে আরও ৫০ হাজার টন চাল টেন্ডারে কেনার জন্য গতকাল বুধবার ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা বৈঠকে উঠানো হয়েছিল। তবে প্রস্তাবে ত্রুটি থাকায় সেটির অনুমোদন মেলেনি।
এদিকে, থাইল্যান্ড থেকে প্রথম দফায় চাল আনা সম্ভব না হলেও দ্বিতীয় দফা আবারও চেষ্টা চলছে। সেই সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে কম্বোডিয়া। এ দুটি দেশ থেকে দুই লাখ টন করে মোট চার লাখ টন চাল আমদানির চেষ্টা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাখাওয়াত হোসেন সমকালকে বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার কাছ থেকে চাল আনার বিষয়টি এখনও আলোচনার টেবিলে রয়েছে।’