‘কাউন্সিল’ বন্ধ না করলে জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে বহিষ্কার হবেন রওশন এরশাদ। তাঁর ছেলে রাহগীর আল মাহি এরশাদ সাদকেও একই শাস্তি দেওয়া হবে। রওশন এরশাদের পক্ষ নেওয়ায় দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গাকে জাপা থেকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদ থেকে অপসারণ করা হবে।
শনিবার বনানী কার্যালয়ে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে দলের প্রেসিডিয়াম ও এমপিদের যৌথসভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য সমকালকে জানিয়েছেন, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে শেষবারের মতো বোঝাতে জাপার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাগনে আহসান আদেলুর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি জাপার এমপি ও দলের যুগ্ম মহাসচিব। চার থেকে পাঁচ দিনের সময় দেওয়া হবে রওশনকে।
জাপায় দেবর-ভাবির বিরোধ বহু পুরোনো। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর তা চরমে পৌঁছে। পরে দুই পক্ষের সমঝোতায় এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য বিরোধীদলীয় নেতার পদে বসেন রওশন। জাপা চেয়ারম্যানের পদে বসেন জিএম কাদের। তাঁরা পরস্পরকে মেনে নেন। এরশাদের রংপুর-৩ আসনে এমপি হন সাদ এরশাদ।
করোনার শুরু থেকেই অসুস্থ রওশন। গত বছরের নভেম্বর থেকে তিনি থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন। গত জুনে সপ্তাহখানেকের জন্য তিনি দেশে ফিরে অভিযোগ করেন, জাপা এলোমেলো হয়ে গেছে। দলের কেউ তাঁর অসুস্থতার খবর নেননি। গত ৩০ আগস্ট থাইল্যান্ড থেকে চিঠিতে রওশন এরশাদ জাপার কাউন্সিল ডাকেন। উদ্দেশ্য জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানো। পাল্টা হিসেবে পরের দিন দলের ২৬ এমপির ২৪ জনের সমর্থন নিয়ে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে স্পিকারকে চিঠি দেন জিএম কাদের। দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব এতে আবারও প্রকাশ্যে এসেছে।
তবে স্পিকার এখনও জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। সূত্র জানিয়েছে, সরকার বিরোধীদলীয় নেতার পদে রওশনকেই চায়। রওশনপন্থিরাও ২৬ নভেম্বর কাউন্সিল করার বিষয়ে অনড়। শনিবার জাপার যৌথসভায় সিদ্ধান্ত হয়, রওশন এরশাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব না হলে, থাইল্যান্ডে তাঁর সঙ্গে থাকা সাদ এরশাদের সঙ্গে আলোচনা হবে। জিএম কাদেরের নেতৃত্ব না মানলে মা-ছেলেকে বহিষ্কার করা হবে।
বেলা ১১টায় শুরু হয়ে টানা পাঁচ ঘণ্টা চলে জাপার যৌথসভা। প্রেসিডিয়ামের ৪১ সদস্যের ৩৮ জন এবং ২৬ এমপির মধ্যে ২০ জন উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া জানিয়েছেন, মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। জিএম কাদের আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানাবেন।
২০১৯ সালে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রওশনের পক্ষে ছিলেন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জাপা নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। আরেক আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ জাপা নেতা মুজিবুল হক চুন্নুও সেই সময়ে রওশনের পক্ষে ছিলেন। এবার তাঁরা দু’জনেই জিএম কাদেরের পক্ষে। দলীয় সূত্র বলছে, বিরোধীদলীয় নেতার পদে রওশনকে চাইলেও তাঁর পক্ষে সক্রিয়ভাবে নেই সরকার ও আওয়ামী লীগ। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় থাকা জিএম কাদেরের পক্ষ সে কারণেই এখনও ভারী।
এরশাদ বর্জন করলেও রওশনকে সামনে রেখে জাপাকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নিয়েছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও প্রয়াত জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। সেই কথা তুলে যৌথসভায় জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমি ম্যাডামকে (রওশন এরশাদ) কিছুদিন আগে ফোনে বলেছি, আপনি আমাদের মাতৃতুল্য। সবসময় আপনার সঙ্গে ছিলাম। আপনি কাউন্সিলের ঘোষণা বাতিল করেন। তিনি ভালো-মন্দ কিছু বলেননি। এরপর আর ফোনও ধরছেন না।’ রওশনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘সিস্টেমের বাইরে যে কাজ করবেন, বিভেদ সৃষ্টি করবেন, তিনি আমার আপন ভাই হলেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সভায় এক এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, সাদ তাঁর মাকে জিম্মি করে রেখেছেন। সাদই মূল সমস্যা। তিনি চাচা জিএম কাদেরকে মানতেই চান না। দলে ছেলের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে সাদকে সমর্থন দিচ্ছেন রওশন এরশাদ। জিএম কাদের যাঁদের জাপা থেকে বাদ দিয়েছেন, বহিষ্কার করেছেন, তাঁরাও সাদের সঙ্গে একজোট হয়েছেন।
রওশন এরশাদ ও সাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জিএম কাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় যৌথসভা থেকে। জিএম কাদের সভায় বলেন, শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হবেন। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
চিঠি দেওয়ার ৪০ দিন পরও স্পিকারের স্বীকৃতি না পেলেও মুজিবুল হক চুন্নু দাবি করেছেন, জিএম কাদেরই বিরোধীদলীয় নেতা। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেছেন, জাপার সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এমপিরা জিএম কাদেরের নেতৃত্বেই সংসদে যাবেন। প্রেসিডিয়ামও সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে। তাই রওশন এরশাদের উচিত হবে, বিরোধীদলীয় নেতার পরিচয় ও পতাকা ব্যবহার না করা। আর, মসিউর রহমান রাঙ্গা নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি করবেন না। তাই বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদে তাঁর বহাল থাকার প্রশ্নই আসে না।
মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ২৬ নভেম্বরের তথাকথিত কাউন্সিলের সঙ্গে জাপার সম্পর্ক নেই। ওই কাউন্সিলকে আমলেও নিচ্ছেন না। রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক, যা অলংকারিক পদ। তাঁর ক্ষমতাই নেই কাউন্সিল ডাকার।
জাপা মহাসচিব আবারও বলেছেন, একাদশ নির্বাচনের পর তাঁরা আর কোনো জোটে নেই। কোনো জোটে যাবে কিনা তা ভবিষ্যৎ বলবে। সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। দেশের কোথাও কোথাও দিনে দুই ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না। সংবাদ সম্মেলনে জাপার কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।