গ্রিড বিপর্যয়: পিজিসিবির তদন্ত প্রতিবেদনের সত্যতা পাচ্ছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) তদন্ত কমিটি ৪ অক্টোবরের গ্রিড বিপর্যয়ের জন্য ৪ বিতরণ কোম্পানির দায় বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। ইত্যেমধ্যে চার বিতরণ কোম্পানি ঘটনার তদন্তে পৃথক পৃথক কমিটি গঠন করেছে। তাদের সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্যের সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদনের অভিযোগের মধ্যে বড় ধরনের অমিল পাওয়া গেছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, প্রতিবেদনের তথ্যের এখনও তেমন সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিশদ তদন্তের পর বিস্তারিত জানানো যাবে।

গত ৪ অক্টোবর ২টা ৫ মিনিটে দেশে গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। ওই দিন ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের ৩২ জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ঘটনার পর নির্বাহী পরিচালক (পিঅ্যান্ডডি) মো. ইয়াকুব এলাহীর নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত রোববার কমিটি তাদের প্রতিবেদন বিদ্যুৎ বিভাগে জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে ঘটনার দিন বিতরণ কোম্পানিগুলোকে লোড কমাতে বলা হলেও তারা তা মানেনি। ওই দিন ঘটনার আগে চার বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি, পিডিবি, ডেসকো ও আরইবিতে ৬ শতাধিক বার ফোন দেওয়া হয়েছিল পিজিসিবির ন্যাশনাল ডেসপাচ সেন্টার (এনএলডিসি) থেকে। কিন্তু পর্যাপ্ত সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং বিপর্যয়ের মুহূর্তে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ নেওয়া শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। রোববার প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিতরণ কোম্পানির কারা দায়ী তা খুঁজে বের করে চলতি সপ্তাহের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

কমিটি গঠন

প্রতিবেদনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গতকাল সোমবার বিতরণ কোম্পানিগুলোকে পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। নির্দেশনা অনুসারে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) পৃথক কমিটি গঠন করেছে।

ডিপিডিসি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির গঠন করেছে। আহ্বায়ক করা হয়েছে প্রধান প্রকৌশলী (গ্রিড) এ এইচ এম মহিউদ্দিন। ডেসকোর তিন সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন, প্রধান প্রকৌশলী (নেটওয়ার্ক অপারেশন- মো. মনজুরুল হক। পিডিবির চার সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন। প্রতি কমিটিতে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন করে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটিগুলোকে তিন কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

গঠিত তদন্ত কমিটিগুলো ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তারা গ্রিড বিপর্যয়ের দিনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু করেছেন। এনএলডিসি কি নির্দেশনা দিয়েছে, তা মানা হয়েছে কিনা, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা আসে বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সরবরাহের জন্য নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলোকে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এনএলডিসির তথ্যও সংগ্রহ করা হবে। সব বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান সমকালকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিচার বিশ্লেষণ করে জানাবে আসলেই সেদিন কি ঘটেছে। ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলীও একই মন্তব্য করেছেন।

তথ্যে গরমিল

সূত্র মতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপর্যয়ের আগে এনএলডিসি থেকে চার বিতরণ কোম্পানিতে ৬ শতাধিকবার ফোন দেওয়া হয়েছিল। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর তদন্ত কমিটি যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছে সেটার সঙ্গে এই তথ্য বিস্তর ফারাক দেখা গেছে। সূত্র বলছে, প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে ৪ অক্টোবর গ্রিড বিপর্যয়ের আগ পর্যন্ত এনএলডিসি থেকে ডেসকোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দুই দফা ফোন এসেছে। এর মধ্যে একটা সকাল ৮ টা ৪০ মিনিটে আরেকটি বেলা ১১টা ১১৫ মিনিটে। এনএলডিসির নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করা হয়েছে। সূত্র আরও জানায় ওই দিন ঘটনার সময় ডেসকোর বরাদ্দ লোড ছিল ৮০০ মেগাওয়াট। তাই নেওয়া হচ্ছিল। ডিপিডিসির সূত্র জানিয়েছে, তাদের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম এনএলডিসি থেকে গ্রিড বিপর্যয়ের আগে তিন দফা ফোন পেয়েছিল।

ডিপিডিসি ও পিডিবির একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, প্রাপ্ত তথ্য বলছে গ্রিড বিপর্যয়ের দিন বরাদ্দের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ গ্রহণের ঘটনার তেমন প্রমাণ মেলেনি। তারা বলছেন, বিতরণ কোম্পানি যদি নির্দেশনা না মানলেও এনএলডিসি নিজেরাই সরাসরি ৩৩ কেভির লাইন অথবা সাবস্টেশনগুলো বন্ধ করে লোড কমিয়ে আনতে পারত। তাদের দাবি, পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের দোষ ধামাচাপা দিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর অযৌক্তি দায় চাপাচ্ছে পিজিসিবি।

একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার সময় দুপুরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি বড় স্টিল কারখানা ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রহণ শুরু করে। তবে ওই কারখানা সরাসরি পিজিসিবির সঞ্চালন লাইন থেকে নিজস্ব সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ গ্রহণ করে। তদন্ত প্রতিবেদনের পরামর্শ অনুসারে গ্রিড বিপর্যয়ের দিন সঠিকভাবে কর্তব্য পালন না করায় সঞ্চালন ব্যবস্থপনা সুরক্ষা দায়িত্বে থাকা পিজিসিবির সিস্টেম প্রোটেকশন ও মিটারিং বিভাগের দুই প্রকৌশলীকে রোববার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।