এমপির পদত্যাগপত্র কবে কীভাবে কার্যকর

songsod

বিএনপিদলীয় সাত এমপি সংসদ ছাড়ার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত কিছুই জানেন না স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। যদিও বিএনপির এমপিরা দাবি করেছেন, তাঁরা ই-মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। আইন অনুযায়ী ই-মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠালে তা আমলযোগ্য হওয়ার সুযোগ নেই। কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, নিজের হাতে লিখিতভাবে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপি আয়োজিত গণসমাবেশে সাত এমপি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। গতকাল সন্ধ্যায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জানিয়েছেন, বিএনপির সংসদ সদস্যদের কোনো চিঠি তিনি পাননি। তাঁর কাছে কোনো চিঠিও আসেনি।

ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুও জানিয়েছেন, এ ধরনের কোনো পদত্যাগপত্র স্পিকারের দপ্তরে পৌঁছেছে কিনা, তাঁর জানা নেই। এ ছাড়া গতকাল স্পিকারের কার্যালয় বন্ধ থাকায় সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি।

সংসদের আইন শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে (বিধি ১৭৭) বলা আছে, সংসদ থেকে কোনো সদস্য পদত্যাগ করতে চাইলে স্পিকারকে সম্বোধন করে নিজের হাতে লিখিত আবেদনে জানাবেন- তিনি পদত্যাগ করতে চান। পদত্যাগের জন্য সংশ্নিষ্ট এমপি কোনো কারণ দেখাতে পারবেন না। এই বিধির শর্তাংশে বলা আছে, কোনো সদস্য যদি কোনো কারণ উল্লেখ করেন, অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ের অবতারণা করেন, তাহলে স্পিকার নিজের বিবেচনামতে ওই শব্দ বাদ দিতে পারবেন এবং তা সংসদের বৈঠকে পড়ে শোনাবেন।

একইভাবে ‘সংবিধানের ৬৭(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোন সংসদ সদস্য স্পিকারের নিকট স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন এবং স্পিকার কিংবা স্পিকারের পদ শূন্য থাকিলে বা অন্য কোন কারণে স্পিকার স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ডেপুটি স্পিকার যখন উক্ত পত্র প্রাপ্ত হন, তখন হইতে উক্ত সদস্যের আসন শূন্য হইবে।’

২০০৯ সালের দশম সংসদ থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে তাঁর সহকারীর মাধ্যমে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন স্পিকারের দপ্তর তা গ্রহণ করেননি। ওই সময়ের স্পিকার (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) আবদুল হামিদ জানিয়েছিলেন, সোহেল তাজ সশরীরে এসে পদত্যাগপত্র জমা দিলে তা গ্রহণ করা হবে। পরে তিনি নিজে এসে পদত্যাগপত্র জমা দেন।

দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় সংসদের ১৪৭ বিরোধী দলীয় সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। এদিন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও এনডিপির সদস্যরা স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।

তৎকালীন স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী পদত্যাগপত্র গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে রুলিং দেন। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগপত্র অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেন। তবে পরে টানা ৯০ দিন সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিতির কারণে তাঁদের আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করা হয়েছিল।

বিএনপিদলীয় এমপি জাহিদুর রহমান জানিয়েছেন, আজ গুলশান অফিসে দলীয় এমপিদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। সেখানে আলাপ-আলোচনার পর সবাই মিলে স্পিকারের দপ্তরে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া হতে পারেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সমাবেশে ই-মেইলে পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া হলেও এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

 

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হওয়া বিএনপির এমপিদের মধ্যে সবার আগে শপথের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের এই এমপি জানিয়েছেন, স্পিকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করলেও তাঁরা আর সংসদে যাচ্ছেন না। তিনি বলেন, এমপিদের পদত্যাগের বিষয়ে এখন থেকে তিন মাস আগেই দলীয় সিদ্ধান্ত ছিল। হাইকমান্ড থেকে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ তাঁরা আগেই পেয়েছিলেন। তখনই বলা হয়েছিল, সারাদেশের বিভাগীয় সমাবেশ শেষ করে ঢাকায় শেষ সমাবেশে এ ঘোষণা দেওয়া হবে। মাস দুয়েক আগেই তাঁরা পদত্যাগপত্রে সই করে দলের কাছে জমা দিয়ে রেখেছিলেন বলেও জানান এই এমপি।

 

একাদশ জাতীয় সংসদে ৩৫০ আসনের মধ্যে বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে একজন সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। পদত্যাগ করতে যাওয়া সাত এমপি হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের আবদুস সাত্তার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হারুনুর রশীদ, বগুড়া-৬ আসনের জি এম (গোলাম মোহাম্মদ) সিরাজ, বগুড়া-৪ আসনের মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান জাহিদ এবং সংরক্ষিত নারী আসনের রুমিন ফারহানা। দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বলে এমপিরা জানিয়েছেন।

গতকালের সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় রুমিন ফারহানা জানান, তাঁরা এরই মধ্যে ই-মেইলে তাঁদের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। আগামীকালের (রোববার) মধ্যে তাঁরা সংসদে তাঁদের সই করা পদত্যাগপত্র জমা দেবেন।

অন্যদিকে জি এম সিরাজ বলেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি আর সংসদে যাবে না। তবে এমপি হারুন অর রশীদ দেশের বাইরে থাকায় তিনি ই-মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত বিএনপির এই এমপি সমকালকে জানান, পদত্যাগের সিদ্ধান্ত তাঁরা আগেই নিয়ে রেখেছেন। তিনি তাঁর স্বাক্ষরিত পদত্যাগপত্র দলের কাছে জমা দিয়েছেন। এটি স্পিকারের দপ্তরে পৌঁছে দেওয়া হবে।

 

গত নির্বাচনে বিএনপি থেকে ছয়জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হলেও তিনি শপথ নেননি। নির্ধারিত সময়ে শপথ না নেওয়ায় তাঁর আসনটি শূন্য ঘোষণা করে পুনর্নির্বাচন হয়। পরে সেখানে জয়ী হন বিএনপি প্রার্থী জি এম সিরাজ।

এদিকে বিএনপির এমপিদের এই পদত্যাগের ঘোষণা জাতীয় সংসদে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে জোট গঠন করে ভোটে অংশ নিয়েছিল। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে শুরুতে বিএনপি সংসদে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয়। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে শপথ নেন দলটির এমপিরা। যদিও বিএনপির নেতৃত্বাধীন এই জোটের অংশীদার গণফোরামের দুই সদস্য মৌলভীবাজার-২ আসনের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ এবং সিলেট-২ আসনের মোকাব্বির খান আগেই শপথ নিয়েছিলেন। ওই সময় তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিল বিএনপি। এর মধ্যে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মনসুর ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে জিতলেও মোকাব্বির খান গণফোরামের দলীয় প্রতীক উদীয়মান সূর্য নিয়ে জিতেছিলেন।