মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরেই বাংলা কাব্যের আধুনিকতার ছোঁয়া ( দ্বিতীয় পর্ব )

মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের নিরলস শ্রম ও আত্মপ্রচেষ্টায় বাংলা কাব্য ও সাহিত্য অনেক অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হয়েছে। তিনি যেমন বাংলাসাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা তেমনি আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার। মহাকবি মধুসূদন মূলত একজন প্রতিভাবান কালজয়ী কবি। বাংলাসাহিত্যের যে বিষয়ের ওপর তিনি নজর দিয়েছেন- সে বিষয়টি নতুনত্বের ছোঁয়া পেয়েছে এবং বিকশিত হয়ে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
তাই যুগস্রষ্টা ও আধুনিক বাংলাসাহিত্যের পথিকৃত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের অহংকার, গৌরব ও বাঙালি জাতীয় সত্তার ও চেতনার প্রতীক। ১৮৬২ সালে ৯ জুন কবি মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার সময়ে ভীষণভাবে এক অর্থাকষ্টে পড়েছিলেন।
তারপরেও তিনি আপন মেধার বলে এবং বহু চেষ্টার ফলে ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। শত অর্থাকষ্ট তাকে তার এই ব্যারিস্টারি পড়তে এতটুকু বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। অবশ্য তার এই বিপদের সময়ে মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহৃয়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর তাই তিনি আর্থিক দুর্বিপাক থেকে অনেকটা উদ্ধার লাভ করেছিলেন।
কবি মধুসূদন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতি অতীব মুগ্ধ হয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা থেকে তিনি তাকে নিয়ে একটি চমৎকার সনেট কবিতা রচনা করেছিলেন। কবি ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ কবিতায় লিখেছেন- বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে, করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে; দীন যে, দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্স্নান কিরণে \হবিগত ১৮৬৭ সালে কবি মধুসূদন বিদেশ ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতার হাইর্কোটে ব্যারিস্টারি হিসেবে যোগ দেন।
এ সময়ে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু তা যথাযথ ধরে রাখতে পারেননি। অমিতব্যয় ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণে তার ওপর আবার নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। ফলে ব্যারিস্টারি ছেড়ে প্রিভি কাউন্সিল আপিলের অনুবাদ বিভাগে চাকরি নিলেন। প্রায় দুবছর এ পদে চাকরি করার পর আবার ব্যারিস্টারিতে ফিরে এলেন। এবারও তিনি তেমন সুবিধা করতে পারেননি। ফলে পঞ্চকোট রাজ্যের আইন উপদেষ্টার পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু এখানেও তিনি বেশি দিন চাকরি করতে পারেননি।
১৮৫৮ সাল থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ বছরের মধ্যে কবি মধুসূদন একে একে রচনা করেন- তিলোত্তমাসম্ভব, মেঘনাদবধ, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য এবং শর্মিষ্ঠা নাটক, পদ্মবতী নাটক, একেই কি বলে সভ্যতা, কৃঞ্চকুমারী নাটক, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো ইত্যাদি নাটক ও প্রহসনসহ বিভিন্ন কাব্য ও কবিতা। এখানে একটি বিষয় উলেস্নখ করতেই হচ্ছে যে, মধুসূদনের অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র পাশাপাশি তার রচিত অন্যান্য রচনা অর্থাৎ সব কাব্যের ভেতরে মানবতার জয়গান প্রকাশ পেয়েছে। মানবিক মূল্যবোধই তার রচনাতে বারংবার উঠে এসেছে। কেননা, মানবিক মূল্যবোধ কিংবা মানবতাবাদ কবি মধুসূদনের চিন্তাচেতনার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল।
একথা সত্যি যে, মধুসূদনের রচনার মধ্যে যে আধুনিকতা আমরা খুঁজে পেয়েছি বা প্রকাশ হয়েছে তা মূলত মানবিকতা অথবা মানবতাবাদেরই দিব্য প্রকাশ। এ ছাড়া তার রচনার মধ্যে মানবতার পরেই স্বাধিকার চেতনার প্রতিবাদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে উঠে এসেছে। কবি মধুসূদন তার জীবদ্দশায় বেশকিছু মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে তিনি প্রথম রচনা করেছিলেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ নামে মহান কাব্যটি। এই কাব্যেও মধুসূদন মানবিকতার দিকটাকে উপস্থাপন এবং নান্দনিকতার প্রকাশ করেছেন। যদিও তিনি নাটক ‘পদ্মবতী’ লেখার সময় অমিত্রাক্ষর ছন্দ আবিষ্কার করেন।
১৮৫৯ সালে মধ্য সময় থেকে ১৮৬০ সালের প্রথম দিকে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’টি রচনা শেষ হয়েছিল। এই বছরেই ওই কাব্যটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আর এই প্রকাশের যাবতীয় ব্যয়ভার সার্বিকভাবে বহন করেছিলেন মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। কবি মধুসূদন প্রকাশিত ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’টি রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছিলেন। এই কাব্যটির মধ্যেও মানবতাবাদের জয়গান ফুটে উঠেছে। কবি মধুসূদনের দ্বিতীয় মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ মহাকাব্য’ বাংলাসাহিত্যে নতুন সংযোজন হয়ে বাংলা মহাকাব্যকে প্রাণ দিয়েছিল। ১৮৬১ সালে কাব্যটির রচনা শেষ হয়েছিল এবং একই সালে কাব্যটি দুই খন্ডে প্রকাশিতও হয়েছিল। রাজা দিগম্বর মিত্র এই মহাকাব্যটির প্রকাশনার সব খরচ বহন করেছিলেন। কবি মধুসূদন তার এই মহাকাব্যটি রাজা দিগম্বর মিত্রের ওপরে উৎসর্গ করেছিলেন।
এই ‘মেঘনাদবধ কাব্যটি’ যখন প্রকাশিত হয় তখন কবির অপার সৃজনশীল প্রতিভা, তার কাব্য সৌন্দর্যবোধ এবং ছন্দ রূপ রস নিয়ে অনেকেই সে সময়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনায় মেতে উঠেছিলেন। বাংলাসাহিত্যের আর এক প্রতিভা ‘বৃত্রসংহার’ মহাকাব্যের রচয়িতা হেমচন্দ্র বন্ধ্যোপাধ্যায় ‘মেঘনাদবধ মহাকাব্য’ সম্পর্কে বলেছেন- ‘মেঘনাদবধ মহাকাব্য রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের আজ কি আনন্দ! এবং কোনো সহৃদয় ব্যক্তি তার সেই আনন্দে আনন্দিত না হইবেন।
অমিত্র-ছন্দে কাব্য রচনা করিয়া কেহ যে এত অল্পকালের মধ্যে এই পয়ার পস্নাবিত দেশে এরূপ যশোলাভ করিবে একথা কাহার মনে ছিল; কিন্তু বোধ হয়, এক্ষণে সকলেই স্বীকার করিবেন যে মাইকেল মধুসূদনের নাম সেই দুর্লভ যশঃপ্রভায় বঙ্গমন্ডলীতে প্রদীপ্ত হইয়াছে।’ মূলত, ‘মেঘনাদবধ মহাকাব্যে’র মধ্যে কবি মধুসূদনের মানবতাবাদী চেতনার, স্বদেশ প্রেমের অমর কাহিনী, বিদ্রোহের সুর এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছে। এখানে তিনি লংকার অধিপতী রাবণকে নায়করূপে উপস্থাপনের ভেতর দিয়ে মানবতাবাদের স্বাধিকারের দেশপ্রেমের এবং দ্রোহের দিকটাকে তুলে ধরেছেন।
আধুনিক কবি মধুসূদন মানবিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে রাবণের মধ্যে মানবতার ভাবকে জাগ্রত করেছেন। ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ কবি মধুসূদনের তৃতীয় কাব্য। এই কাব্যটি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার আগে লেখা হয়েছিল। কবি এই কাব্যে রাধাকে মানুষের পৃথিবীর বুকে একজন অতীব মানবী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি এখানে দেখাতে চেয়েছেন যে, রাধা মানবী হওয়া সত্ত্বেও একজন সাধারণ নারী।
‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ কবি মধুসূদনের চতুর্থ ও শেষ কাব্য। এই কাব্যটি ১৮৬২ সালে প্রথম দিকে কবি রচনা করেন এবং একই বছরে শেষ দিকে কাব্যটি প্রকাশিত হয়। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’টি মূলত পত্র-কাব্য হিসেবেই অধিক পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে ইহা পত্রাকারে রচিত এই ধরনের কাব্য এটিই প্রথম। কবি মধুসূদন এই কাব্যে উলিস্নখিত নারীদের ধর্মের বেড়াজাল ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপেই আধুনিক নারী হিসেবে আধুনিকতার রঙে পরশ রাঙিয়ে সমাজের সামনে কালের সম্মুখে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’র নারীরা এখানে মানবতাবাদী প্রেমের প্রতীক হয়ে উঠে এসেছে। বহু প্রতিভার অধিকারী কালজয়ী মহাকবি মধুসূদন কাব্যসাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ ও বিকাশ ঘটিয়েছেন, তেমনি আবার নাট্যসাহিত্যকেও সমানভাবে সমৃদ্ধ ও শৈল্পিক করে তুলেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য রীতিনীতি অনুসরণে চতুর্দশপদী কবিতার পাশাপাশি নাট্যকাব্যও রচনা করেছেন। ‘শর্মিষ্ঠা নাটক’ কবির প্রথম বাংলা রচনা। এটি বিগত ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদও করেছিলেন।
গ্রিক পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে কবি মধুসূদন রচনা করেছিলেন ‘পদ্মাবতী নাটক’। এই নাটকটি ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রো’ নামে দু’টি ব্যঙ্গাত্মক প্রহসন প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। এই প্রহসন দু’টির প্রকাশনার খরচ বহন করেছিলেন বেলগাছিয়া ছোটো রাজা ইশ্বরচন্দ্র সিংহ। এ দু’টি প্রহসন কবি মধুসূদন বেলগাছিয়া থিয়েটারের জন্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় যে, এই এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ভীষণ আপত্তির ফলে প্রহসন দুটি মঞ্চস্থ হতে পারেনি। এতে করে কবি মানসিকভাবে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ‘কৃঞ্চকুমারী’ ও ‘মায়াকানন’ নামে কবি আরও দু’টি নাটক রচনা করেছিলেন। ১৮৬১ সালে ‘কৃঞ্চকুমারী নাটক’ এবং ১৮৭৪ সালে মার্চ মসে ‘মায়াকানন নাটক’টি প্রকাশিত হয়।
কবি মধুসূদনের ‘হেক্টরবধ’ একটি গদ্যকাব্য রচনা। এটি পৃথিবীর বিখ্যাত মহাকবি হোমারের ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যের কাহিনী অবলম্বনে অনুবাদ রচনা। মহাকবি হোমারের ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যটি কবি মধুসূদন গ্রিক ভাষায় পড়ার পর সেটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। যদিও কবি মধুসূদন দত্ত তার জীবদ্দশায় এই অনুবাদ রচনাটি শেষ করতে পরেননি। ফলে ১৮৭১ সালে ১ সেপ্টেম্বর মাসে ‘হেক্টরবধ’ গ্রন্থটি অসমাপ্ত অবস্থাতেই প্রকাশিত হয়।
( ধারাবাহিক প্রতিবেদনের কাল থাকছে…….. তৃতীয় পর্ব )