নাট্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্ত বিচিত্র প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন

Michael Madhusudan Dutt

আধুনিক রীতির নাটক রচনা করে মধুসূদন পরবর্তী নাট্যকারদের নাটক রচনায় বিশেষভাবে প্রভাবিত করেন। ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি নাটক রচনায় এবং প্রহসন রচনায় মধুসূদন নাট্য ক্ষেত্রেও বিচিত্র প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

বাংলা নাট্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্তের অবদান ও কৃতিত্ব শুধু বাংলাকাব্য ক্ষেত্রেই নয়, নাট্যসাহিত্যেও  মধুসূদন  আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। মধুসূদনের পূর্বে বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীর নাটক তখনও কেউ লেখেননি। সরাসরি অনুবাদধর্মী নাটক রচনার দিকেই ছিল সমসাময়িকদের লোভ বেশি। তাও আবার সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ। প্রকৃত প্রস্তাবে মধুসুদনই বাংলা নাট্য সাহিত্যে মৌলিক পূর্ণাঙ্গ নাটকের নাট্যকার হিসাবে স্বীকৃত হতে পারেন। তাই নাট্যসাহিত্যের ধারায় মধুসূদনের কৃতিত্ব সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক উভয়দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।

‘শ্রীহর্ষ প্রণীত ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরাজী অনুবাদ করতে গিয়ে মধু কবির মনে নাটক লেখার বাসনা জাগে। যদিও মাদ্রাজে থাকার সময় ‘Rizia’ নামক একটি ইংরাজী নাটক কবি লিখেছিলেন, কিন্তু ছাপা হয়নি। মধুসূদনের প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), এতেই প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ নাটকের বৈশিষ্ট্য দেখা গেল। নাটকটিতে মহাভারতীয় আখ্যান, ও প্লট রচনায় কালিদাসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের মূল্য যতটা ঐতিহাসিক, ততটা সাহিত্যিক নয়। নাটকের সংলাপে তৎসম শব্দের বাহুল্য, সংস্কৃত, বাক্যরীতি নাট্যগতিকে শ্লথ করেছে। নাটকে ইংরাজী ভাব ভাবনার স্পর্শ আছে বলে দাবি করা হলেও ‘শর্মিষ্ঠা’ সংস্কৃত নাট্যরীতির বাধা পথ থেকে দূরে সরে যায়নি। ইংরাজী নাট্যকলার সুখ স্বপ্ন মাত্র দেখেছিলেন নাট্যকার। বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত হবার জন্য ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের উৎপত্তি নাটকটি রচনায় মধুসূদন তৃপ্তি পাননি।

মধুসূদনের পরবর্তী নাটক ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০) গ্রীক পুরাণের আদর্শে রচিত। বিদর্ভ রাজ ইন্দ্রনীল রতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন করায় শচী ও মূরজা তার শত্রু হয়। এই শত্রুতা ও তার অবসান নিয়েই নাট্যকাহিনী গড়ে উঠেছে। এ ঘটনা বাংলা নাট্যসাহিত্যে অভিনব। গ্রীক কাহিনী অবলম্বনে এই নতুন প্লটটি গড়ে তুলে নাট্যকার যথেষ্ঠ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু পাশ্চাত্য কাহিনীকে গ্রহণ করা হলেও বিন্যাস কৌশলে কবি সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যের আদর্শকেই মোটামুটি অনুসরণ করেছেন। তবে প্রথম নাটক অপেক্ষা এই নাটক রচনায় নাট্যকার অন্তত একধাপ এগিয়েছেন। তার প্রমাণ এর সুগঠিত ঘটনা সংস্থাপন।

মধুসূদনের তৃতীয় নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১) বাংলায় প্রথম ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি নাটক। এই নাটকে সংস্কৃত প্রভাব পরিত্যাগ করে পাশ্চাত্য নাট্য রীতিকে অবলম্বন করেন। সবচেয়ে বড় কথা ইতিহাসের পটভূমিকায় নাটকের বিয়োগান্ত পরিণতি ঘটিয়ে মধুসূদন তাঁর বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় দিয়েছেন। নাট্য কাহিনী তিনি গ্রহণ করেছিলেন টডের লেখা ‘Annals and Antiquities of Rajasthan’ গ্রন্থ থেকে। রাণা ভীম সিংহের কুমারী কন্যা কৃষ্ণকুমারী পিতাকে দারুণ বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করেন। মানসিংহ ও জয়সিংহ উভয়েই কৃষ্ণার পাণি প্রার্থনা করেন এবং ভীমসিংহের সর্বনাশ করবেন বলে ভয় দেখান। একদিকে কন্যা -স্নেহ অপরদিকে রাজ্য রক্ষা এই উভয় সঙ্কটের সমাধান হল কৃষ্ণকুমারীর আত্মহত্যায়। নাটকটির সঙ্গে গ্রীকনাট্যকার ইউরিপিদেস্ রচিত ইফিগেনিয়া এ্যাট চৌরিস’ নাটকের কিছুটা সাদৃশ্য মেনে। ভীমসিংহের চরিত্রে পিতৃবাৎসল্য এবং রাজ-কর্তব্যের সংঘাত নাটকীয় কৌশল সৃষ্টিতে সার্থক হয়েছে। মধুসূদনের পরবর্তী পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘মায়াকানন’ ‘কৃষ্ণকুমারী’র মতই বিয়োগান্ত নাটক। নাটকের কোন কোন দৃশ্যে ‘পদ্মাতী’ নাটকের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।

প্রথম দুটি নাটকে নারীর ঈর্ষা নাট্যসংঘাত সৃষ্টি করে নাটককে পরিণতির দিকে চালিত করেছে। মায়াকাননে নারীর চক্রাস্ত নাট্য পরিণতিতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। নাটকের ভাষা ‘পদ্মাবতীর’ মত গতিশীল নয়।

গভীর রসের নাটকের পাশাপাশি মধুসুদন দুটি প্রহসন নাটক লিখে বিচিত্র প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। মধুসুদন একটিও পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নাটক লেখেননি, কিন্তু প্রহসন দুটি সামাজিক প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা৷ প্রহসন দুটি হল ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) এবং ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০)। ইংয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের মাদকাসোক্তি ও তাদের আনুসঙ্গিক অন্যান্য দোষের বর্ণনা দিয়ে লেখেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’। ইংরেজী শিক্ষিত তরুণ যুবকদের ভ্রষ্টাচারকে শানিতবঙ্গ ব্যঙ্গের ভাষায় দারুণ কষাঘাত করেছেন নাট্যকার। প্রহসনটির অনুসরণে দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন ‘সধবার একাদশী’। ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ উদ্দেশ্য বিহীন, তবে তৎকালীন সমাজের একশ্রেণীর বক্ ধার্মিকদের উপলক্ষ্য করে এই প্রহসন রচিত হয়েছে। বক্ ধামিক বৃদ্ধের গোপন লাম্পট্যকে সূতীক্ষ্ণ কৌতুকবাণে বিদ্ধ করা হয়েছে।

জমিদার ভক্তপ্রসাদের চরিত্রহীনতা ও লাঞ্ছনা উজ্জ্বলভাবে চিত্রিত। সেই প্রহসন দুটি উদ্দেশ্যমূলক রচনা হলেও কখনও চরিত্রকে খর্ব করেনি। সমকালীন কোনও কোনও সমালোচক মধুসুদন বাংলা জানতেন না, বলে অভিযোগ করেন। ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাই লেখেন এই দুখানি প্রহসন থেকেই দেখা যাবে মধুসুদন নানা ধরনের বাংলা, মায়া উপভাষা—কতটা জানা ছিল, আর জনজীবনের সঙ্গে তিনি কতটা নিবিড় ভাবে পরিচিত ছিলেন।” বস্তুত মধুসুদন যদি আর একটিও নাটক না লিখতেন তবুও এই প্রহসন দুটিই নাট্যকার মধুসূদনের কৃতিত্ব বিচারে যথেষ্ঠ ছিল।