মহান স্বাধীনতা দিবস আজ

বাঙালির গৌরবের ২৬ মার্চ, আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস । নিত্যদিনের মতো আজও ভোরের সূর্যালোকের বর্ণচ্ছটায় রাঙাবে কৃষ্ণচূড়া, গ্রামীণ পথের শেষে নদীর তীরে অশ্বত্থ শাখা থেকে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুতান,নীল আকাশের বুকে ডানা মেলবে উড়ন্ত বলাকার ঝাঁক, কলকাকলিতে মুখরিত হবে আজ জনপদ। তবুও অন্য যে কোন দিনের চেয়ে আজকের দিনটি সম্পূর্ণ আলাদা। ভিন্ন আমেজের, ভিন্ন অনুভূতি ও ভিন্ন স্বাদের আমাদের এই প্রিয় স্বাধীনতা দিবস।

 

আজ ২৬ মার্চ রক্ত, অশ্রুস্নাত বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহের দিন। বাঙালীর শৃৃঙ্খলমুক্তির দিন। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস।বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন আজ। মহার্ঘ্য স্বাধীনতা। কিন্তু বাঙালী জাতিকে এ জন্য দিতে হয়েছে চরম মূল্য। দেশের মহার্ঘ্য স্বাধীনতার ৫২ বছরের এই ক্ষুদ্র পরিসরে দেশ ও জাতি অনেক ঘটন-অঘটন, চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী হয়েছে। সময়ে সময়ে এসব ঘটনা সমগ্র জাতিকে প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়েছে, পাল্টে দিয়েছে এর গতিপথ। কখনও জাতির জীবনে এসেছে হতাশা-অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্ত, কখনও বা হয়েছে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় উজ্জীবিত। যদিও ৫২ বছর একটি জাতির জীবনে খুব বড় পরিচয় নয়, গড় আয়ুর নিরিখে হয়ত বা একটি প্রজন্ম মাত্র, তথাপি পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা সহস্র বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আত্মমর্যাদায় বলীয়ান একটি জাতির সামনে মাইলফলক অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। যেমনটি টানা তৃতীয় মেয়াদে বঙ্গবন্ধুরকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বদলে গেছে বাংলাদেশ, নতুন প্রজন্মের সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের সত্য ও সঠিক ইতিহাস। ইতিহাসের খলনায়করা হারিয়ে গেছে সত্য ইতিহাসের বিশাল স্তূপের নিচে।

 

 

জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে গৌরবের স্মৃতি নিয়ে আবারও ফিরে এসেছে চির অম্লান, আনন্দ-বেদনায় মিশ্রিত দিবসটি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের আজ ৫২তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। আজকের দিনে বাঙালী তার স্বর্ণ অতীতের দিকে ফিরে তাকাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার নতুন শপথ, নব উজ্জীবন ঘটবে জাতীয় জীবনে।

 

 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল একটি ভূখণ্ডের, আজ যার নাম বাংলাদেশ। সবুজের জমিনে রক্তিম সূর্যখচিত মানচিত্রের দেশটি আজ নানা আয়োজনে দিবসটি উদযাপন হচ্ছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন।

 

হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালী জাতি। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল এ ব-দ্বীপের মানুষ। ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তে রাঙিয়ে, আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে একাত্তরের এই দিনে যে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের মানুষ, দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন তার চূড়ান্ত পরিণতি হয়েছিল। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহঙ্কারের দিন আজ।

 

প্রতিবছর মহান স্বাধীনতা দিবস জাতির জীবনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়ার নতুন বার্তা নিয়ে আসে। ভয়াল ‘কালরাত্রি’র পোড়া কাঠ, লাশ আর জননীর কান্না নিয়ে রক্তে রাঙা নতুন সূর্য উঠেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ভয়াল কালরাতের ধ্বংসস্তূপ আর লাশের ভেতরে দিয়ে রক্ত রাঙা সেই নতুন সূর্য। ভীতবিহ্বল মানুষ দেখল লাশপোড়া ভোর। সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ। আকাশে কু-লী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। পুড়ছে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা লালসবুজ পতাকা। জ্বলছে শাড়ি, খুকুর ফ্রক। চোখে জল। বুকে আগুন। জ্বলে উঠল মুক্তিকামী মানুষের চোখ, গড়ল প্রতিরোধ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ‘জয় বাংলা’ বলে ট্যাঙ্কের সামনে এগিয়ে দিল সাহসী বুক। একাত্তরের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী হিংস্র শ্বাপদের গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

 

শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবনপণ সশন্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বাঙালী। দীর্ঘ নয় মাস এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে হাজার বছরের বাঙালীর শ্রেষ্ঠতম অর্জন- মহান স্বাধীনতা। আজ ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালী জাতির জীবনে সূচনা ঘটেছে আরও একটি ঝলমল উৎসবের দিনের। রক্ত, অশ্রুস্নাত বিক্ষুব্ধ বিদ্রোহের দিন ২৬ মার্চ। এ ভূ-ভাগের সবচেয়ে বড় অর্জন, বাঙালীর সহস্র বছরের জীবন কাঁপানো ইতিহাস- মহান স্বাধীনতা। অসংখ্য শহীদের রক্তে ভেজা, জাতির বীরসেনানীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা দিন। বাঙালীর স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিন। গৌরব ও স্বজন হারানোর বেদনার এই দিনে বীর বাঙালী সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করেছিল। তাই আজ গৌরব ও অহঙ্কারের দিন।

 

স্বাধীনতার এই দিনে জাতি মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। দিবসটির প্রথম প্রহরে জাতির বীর সন্তানদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনরা। এর পরই জাতির গৌরব আর অহংকারের এ দিনটিতে সৌধ প্রাঙ্গণে ঢল নেমেছে লাখো মানুষের। তাদের হৃদয় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে স্মৃতিসৌধ।

 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ।

 

 

একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় ও বঙ্গবন্ধুকে মধ্যরাতে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের তাৎক্ষণিক পূর্বে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করেন। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।

 

সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান । মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খন্ডে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঘোষণা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি। যা তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

 

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।’

 

 

সেই প্রবল প্রদীপ্ত আন্দোলনের জোয়ারে ধীরে ধীরে বাঙালীর হৃদয়ে আঁকা হয় একটি লাল-সবুজ পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ছবি। কিন্তু বাঙালীর আবেগ, সংগ্রাম ও মুক্তির আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করতে অস্ত্র হাতে নামে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী। শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু করে নিষ্ঠুর গণহত্যা। সেই কালরাত থেকেই শুরু হয় মৃত্যু, ধ্বংস, আগুন আর আর্তনাদের পৈশাচিক বর্বরতা। কিন্তু ওই ঘোরতর অমানিশা ভেদ করেই দেশের আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার চিরভাস্বর সূর্য।

 

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী মাথানত করে পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা- যাঁর নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যাঁদের রক্ত ও সম্ভ্রমের মূল্যে আমরা পেয়েছি মহামূল্যবান এই স্বাধীনতা, তাঁদের কাছে মহামূল্য ঋণ গভীর কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবার দিন আজ। মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর বেদনায় স্মরণ করবে মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদকে। স্মরণ করবে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী তাঁর সহকর্মী জাতীয় নেতাদের। জাতি শ্রদ্ধা জানাবে বীরাঙ্গনা আর শহীদ মাতাদের। দৃপ্ত শপথ নেবে- জঙ্গী-সন্ত্রাস, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও যুদ্ধাপরাধীমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে। স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুদের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার। কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি আজ দৃঢ় শপথে বলীয়ান হবে সকল অন্ধকারের শক্তিকে পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ে তোলার।