নাগরিকত্ব নয়, কার্ড দিয়ে রোহিঙ্গা নেবে মিয়ানমার

চলতি মাসের মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় পাইলট ভিত্তিতে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তারই অংশ হিসেবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগেই রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখে মিয়ানমার ঘুরে এসেছেন ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য সবচেয়ে জরুরি নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান ছাড়াই প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় নেপিদো। তবে রোহিঙ্গাদের দাবি, নাগরিকত্ব দিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে।

রাখাইনে যাওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের প্রধান মোহাম্মদ ছলিম বলেন, রাখাইনে ১৫টি গ্রাম পরিদর্শনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলকে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক কী পরিমাণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, তা দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে তারা প্রত্যাবাসনের আগে নাগরিকত্ব না দিয়ে এনবিসি কার্ড (অতিথি কার্ড) দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেতে চায়। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলেছে, সেখানে যাওয়ার ছয় মাস পর নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এর উত্তরে আমরা বলেছি, আগে নাগরিকত্ব দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে।

গতকাল সকালে কক্সবাজারের টেকনাফের ট্রানজিট জেটি ঘাট দিয়ে প্রতিনিধি দল মিয়ানমারের উদ্দেশে যাত্রা করে। এ দিনই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে একই পথে টেকনাফে ফিরে এসেছেন তাঁরা। কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে তিন নারীসহ ২০ জন রোহিঙ্গা, ছয়জন সরকারি কর্মকর্তা ও একজন অনুবাদক ছিলেন।

সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব মো. খালেদ হোসেন, ডিজিএফআই প্রতিনিধি মেজর মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, এনএসআই প্রতিনিধি মোহাম্মদ শাহজাহান আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব বিশ্বজিৎ দেবনাথ, বিজিবি প্রতিনিধি মো. আনোয়ার হোসেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাহজাহান ও অনুবাদক তারিক ইমরান রয়েছেন। প্রতিনিধি দলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে টেকনাফের লেদা, নয়াপাড়া ও জাদিমুড়া এলাকায় অবস্থিত ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের নেতারা ছিলেন।

প্রতিনিধি দলটি শুক্রবার দুপুরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ১৫টি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফের জেটি থেকে রওনা দেওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলটি নাফ নদ অতিক্রম করে রাখাইন রাজ্যের নাকফুরা খালের জেটিতে পৌঁছায়। সকাল সোয়া ১০টার দিকে নাকফুরা ঘাটে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্যদের স্বাগত জানান সেখানকার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা।

নাকফুরা ঘাটে পৌঁছার পর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের গাড়িতে তুলে পাশের গ্রাম বলিবাজারে নেওয়া হয়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নাকফুরা, বলিবাজার, থায়াংখালী ও ঝিমংখালী গ্রাম ঘুরিয়ে সড়কপথে নেওয়া হয় মংডু শহরে।

দুপুর দেড়টার দিকে মংডু ট্রানজিট ক্যাম্পে দুপুরের খাওয়া শেষে দুই দেশের মধ্যে প্রত্যাবাসন ও যাচাই করা প্রত্যাবর্তনকারীর ব্যবস্থা-সম্পর্কিত বিষয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইমিগ্রেশন দলের মধ্যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়। এরপর মংডুর পাশের গ্রাম কাহারীপাড়া, নুরুল্যাপাড়া, সিকদারপাড়াসহ আরও কয়েকটি গ্রাম দেখানো হয়। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মংডুতে নির্মিত ট্রানজিট কেন্দ্রসহ নানা অবকাঠামোও ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে মংডু ট্রানজিট ঘাট থেকে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা স্পিডবোটে চড়ে সোয়া ৫টায় টেকনাফে পৌঁছান।

গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে মিয়ানমারের ২২ সদস্যের প্রতিনিধি দল টেকনাফ এসে ১৭৭টি পরিবারের ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করেছিল। ওই তালিকা থেকেই ২০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়।

মিয়ানমার থেকে ফিরে বিকেলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট এলাকা ঘুরে এসেছি এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ খুবই আন্তরিক। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে আবারও বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন, এরপর প্রত্যাবাসন শুরু হবে। তবে যেভাবেই হোক না কেন আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই।

এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছে। তার মধ্য থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া যায়। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাঁদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১টি শিশুর তথ্য সংগ্রহ করে। এখন রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনে তাদের প্রতিনিধি দল রাখাইনের পরিস্থিতি দেখার সুযোগ পেয়েছে।