পায়রায় ১ মাসে গচ্চা ১৮০ কোটি টাকা

সমন্বয়হীনতা, অব্যবস্থাপনা আর ভুল পরিকল্পনার কারণে বন্ধ থাকার পরও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ১৮০ কোটি টাকা। বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে এ টাকা গচ্চা দিতে হবে সরকারকে। চুক্তি অনুযায়ী কোনো কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না কিনলে প্রতি ইউনিট (পার কিলোওয়াট আওয়ার) বিদ্যুতের জন্য পায়রাকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ৪ টাকা। সে হিসাবে ১ মাসে ১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য দিতে হবে ১৮০ কোটি টাকার বেশি অর্থ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন বন্ধ থাকায় একদিকে বিদ্যুতের অভাবে দেশব্যাপী মানুষজন চরম কষ্ট ভোগ করছেন অপরদিকে অহেতুক ক্যাপাসিটি চার্জে খালি হচ্ছে সরকারের কোষাগার। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উৎপাদনে আসার পর থেকে ১ দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ছিল না কোনো কারিগরি ত্রুটিও।

সবকিছু ঠিক থাকার পরও শুধু ভুল পরিকল্পনা আর সমন্বয়হীনতার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে। জানা গেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ডলার জোগানের বিষয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও যথাসময়ে কয়লা আমদানির জন্য ডলার সংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, উন্নত প্রযুক্তির কারণে এখন কমপক্ষে এক মাসের অগ্রিম আবহাওয়া ফোরকাস্ট জানা সম্ভব।

ওই ফোরকাস্টে জুনে তীব্র দাবদাহের কথা বলা থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা আমলে নেননি। যার কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানির বিষয়ে একাধিক চিঠি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গেলেও কেউ কর্ণপাত করেননি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানির গতি হলেও সরকারের কোষাগার থেকে গুনতে হবে কমপক্ষে ১৮০ কোটি টাকার বেশি অর্থ। প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত উদ্যোগ না হলে এ ক্যাপাসিটি চার্জ আরও বেশি গুনতে হতো বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

একই অবস্থা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। উৎপাদন শুরু করার মাত্র ২৭ দিন পর বন্ধ হয়ে যায় বহুল আলোচিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট। অথচ কারিগরি কোনো সংকট ছিল না কেন্দ্রটি পরিচালনায়। শুধু ডলার সংকটের কারণে ইন্দোনেশিয়া কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। জানা গেছে, এই দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মাসে ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। একদিকে মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। বিদ্যুতের অভাবে গ্রামে ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে, অপরদিকে অহেতুক শত শত কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, ‘ক্যাপাসিটি চার্জ হচ্ছে বিনিয়োগের অংশ। আমরা যদি এটি সরিয়ে দিই, তাহলে পৃথিবীর কেউ এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে না। পিডিবিকেও কিন্তু দিতে হচ্ছে (ক্যাপাসিটি চার্জ)। যদি বিদ্যুৎ নাও নিই, তাও দিতে হচ্ছে।’

শুধু রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রই নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরে এরকম আরও অসংখ্য ক্ষেত্রে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর সমন্বয়হীনতা রয়েছে। যার কারণে এর সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। কিন্তু সরকারের কোষাগার থেকে ঠিকই চলে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। জানা গেছে, বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক ১১ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। অথচ এরমধ্যে কমপক্ষে ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সরকারের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে।

পুরোনো ও মান্ধাতা আমলের কেন্দ্র হওয়ায় এগুলো থেকে ২০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সরকারের তালিকায় থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে কেন্দ্রগুলো। একই অবস্থা ফার্নেস অয়েল, ডিজেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও।

জানা গেছে, বর্তমানে সরকারের হিসাবে কাগজে-কলমে ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও কমপক্ষে ৭ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের লোড ফ্যাক্টর ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি নয়। বিদ্যুৎ বিভাগের উচিত ছিল আরও কমপক্ষে ৩ বছর আগে কেন্দ্রগুলো (ফেইজ আউট) বহর থেকে বাতিল করে ফেলা। কিন্তু অভিযোগ আছে, একটি সিন্ডিকেট নানা অনৈতিক সুবিধা আর লুটপাট করতে কেন্দ্রেগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

সরকারের হিসাবে বিদ্যুতের চাহিদা এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াট। যদিও প্রকৃত চাহিদা এরচেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে উৎপাদনের ক্ষমতা ৩২ শতাংশ বেশি। এরপরও দেশজুড়ে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। গ্রামে ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ঘাটতি ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকটে জ্বালানি (তেল, গ্যাস ও কয়লা) আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস অয়েল আমদানি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল বাবদ বর্তমানে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে জ্বালানি খাতের তেল-গ্যাস ও কয়লা আমদানির জন্য ডলারের চাহিদা রয়েছে ৪২০ কোটি ডলার। অপরদিকে এই তিন খাতে এ পর্যন্ত এলসির দেনা বকেয়া রয়েছে ১০৫ কোটি ডলার। কিন্তু এত বিশাল চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ১০ কোটি ডলার।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম অনেক কমে গেছে। গত বছরের আগস্টে প্রতি টন কয়লার দাম ছিল ২৫৭ ডলার। এখন তা কমে ১৩১ ডলারে নেমেছে। ওই সময়ে কয়লার দাম কমেছে ৪৯ শতাংশ। তারপরও ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি করতে পারছে না সরকার।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কোনো এলসি খোলা সম্ভব হয়নি। তবে আগের খোলা এলসি থেকে আমদানি হয়েছে ১১৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে কোনো এলসি খোলা হয়নি।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, চাহিদার চেয়ে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩২ শতাংশ বেশি। ফলে জ্বালানি সংকট ছাড়াও অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকে। কিন্তু তাদের ক্যাপাসিটি চার্জের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। যা বিদ্যুৎ খাতের জন্য বাড়তি বোঝা তৈরি করেছে।

তিনি বলেন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করার জন্য করা হয়েছে। প্রথমত, ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনে চুক্তি করা হয়েছে। বিশেষ করে কুইক রেন্টালের ক্ষেত্রে রীতিমতো লুটপাট করা হয়েছে।’ গত ১২ বছরে ক্যাপাসিটি পেমেন্টের নামে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি নিয়ে গেছেন বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটের জন্যই চাহিদা না থাকলেও একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো হয়েছে। দেশি গ্যাস, কয়লার উত্তোলন আর অনুসন্ধানের উদ্যোগ না নিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকেছে সরকার। কারণ এতে কমিশন মেলে। যার কুফল এখন ভোগ করছে জনগণ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, সরকারের অব্যবস্থাপনায় সংকট বেড়েছে। সময়মতো ডলার ছাড়লেই সংকট ঘনীভূত হতো না।

তিনি বলেন, সরকার ডলার ছাড়ছে না, তা নয়। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ততদিনে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন কয়লা আসতে আরও ৩ সপ্তাহ সময় লাগবে। এই অর্থটুকু আরও ১ মাস আগে দিলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করতে হতো না। বিদ্যুৎ না পেলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসাবে পায়রাকে ঠিকই বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে হবে।