বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির নতুন দিগন্ত

দেশের উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ১৯৯২ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে প্রায় ৩২ বছর পার হলেও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর অনুমোদন পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সম্প্র্রতি যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সোয়াস (স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ) ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সঙ্গে যৌথভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারই প্রথম পিএইচডি প্রোগ্রামের যাত্রা শুরু হলো।

এছাড়া নর্থ সাউথ, আইইউবি, ইআইইউ, ড্যাফোডিলসহ আরও কয়েকটি মানসম্মত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পিএইচডি প্রোগ্রাম শিগ্গিরই চালু হতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক আবদুল হান্নান সোমবার বলেন, আমরা স্বতন্ত্র পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর অপেক্ষায় আছি। পিএইচডি প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য আমাদের সব ধরনের সক্ষমতা আছে। এ বিষয়ে ইউজিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে।

যারা উন্নয়ন নীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি বা উন্নয়ন অধ্যয়নের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর গবেষণায় আগ্রহী, তাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় সুযোগ পাখা মেলছে, যা দেশে গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত হিসাবে দেখছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। জানা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির অনুমোদন দেওয়ার জন্য একটি নীতিমালা তৈরির প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে এনেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। দ্রুতই এ নীতিমালা অনুমোদন করবে প্রতিষ্ঠানটি। তবে যেসব শর্তে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর অনুমোদন দেওয়া হবে তাতে প্রথমদিকে ৮-১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ সুযোগ পাবে।

এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান ড. এসএমএ ফয়েজ বলেন, আমরা গবেষণার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছি। পিএইচডি ব্যয়বহুল প্রোগ্রাম। আর্থিক সংকটের কারণে আমরা বেশিদূর এগোতে পারিনি। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করছি। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন যৌথভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে আমরা উন্নত গবেষণায় পদার্পণ করলাম।

এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার অবস্থান তৈরি হয়েছে। একইভাবে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র‌্যাকিং-এ পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল কোলাবোরেশন না থাকা। যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত মান ধরে রেখেছে, তাদের পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করতে আমরা সহায়তা করব। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ হাইকমিশনও এগিয়ে আসবে।

এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টারও বেশ আগ্রহ রয়েছে জানিয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর জন্য আমরা একটা গাইডলাইন তৈরি করছি। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিকে এ গাইডলাইন অনুসরণ করার শর্তে পিএইচডি প্রোগ্রাম পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি প্রোগ্রামটি ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অব ডেভেলপমেন্ট’ শিরোনামে চালু হচ্ছে। যেখানে গবেষণার বিষয় হিসাবে থাকবে কার্যকর দুর্নীতি দমন; রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ; শাসনব্যবস্থার সংস্কার; নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া, অভিযোগ প্রতিকার এবং সরকারি খাতের জবাবদিহিতা; ব্যবসায়িক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ; সরকারি পরিষেবা প্রদানের রাজনীতি (যেমন: শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা বা জ্বালানি খাত); দুর্যোগের রাজনীতি; নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও লিঙ্গ সমতা; বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন; শ্রমবাজার, শ্রম অধিকার এবং আরও নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রোগ্রামটি পরিচালিত হবে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং সোয়াস-এর ইকোনমিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধীনে। এই প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, উন্নয়ন গবেষণায় পড়াশোনার জন্য যারা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তারা সীমিত সময়ের জন্য ফিল্ডওয়ার্ক করে থাকেন। কিন্তু এই পিএইচডি প্রোগ্রামে গবেষণার একটি বড় অংশ সম্পন্ন হবে বাংলাদেশে। এটি গবেষণাকে আরও কার্যকর ও বাস্তবমুখী করে তুলবে।

জানা যায়, ১৬ জুন সোয়াস-এর লন্ডন ক্যাম্পাস ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি মেরুল বাড্ডা ক্যাম্পাসে একযোগে যৌথ পিএইচডি প্রোগ্রামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। সোয়াস-এর লন্ডন ক্যাম্পাসে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিপত্রে সই করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি প্রফেসর অ্যাডাম হাবিব ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন তামারা হাসান আবেদ। লন্ডনে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার বলেন, ইতোমধ্যে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি একাডেমিক কারিকুলাম, গবেষণা ও সামগ্রিক অবকাঠামোর বিচারে নিজেদের ভিন্নতা ও অনন্য অবস্থান প্রমাণ করেছে। এছাড়া দেশের উচ্চশিক্ষার প্রেক্ষাপটে ব্র্যাক ও সোয়াস-এর এ যৌথ পিএইচডি প্রোগ্রাম অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী।

সরকারের কাছ থেকে পিএইচডি চালুর উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, প্রস্তাবিত নীতিমালায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের যোগ্যতা ও সক্ষমতা নির্ধারণে একটি মানদণ্ড (ক্রাইটেরিয়া) থাকবে। মানদণ্ড অনুযায়ী যোগ্য বিশ্ববিদ্যালয় এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর অনুমোদন পাবে। যোগ্যতার মাপকাঠির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নবায়ন থাকতে হবে। পিএইচডি গবেষণার জন্য অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। প্রোগ্রাম চালুর ক্ষেত্রে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক থাকতে হবে। পিএইচডি গবেষণার ক্ষেত্রে অন্য স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-সুপারভাইজার মনোনয়ন দিতে হবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, পিএইচডি নীতিমালায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকবে। সেগুলো হলো-সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ড, পিএইচডির সুপারভাইজার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানদণ্ড। তবে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমা থাকবে না। এটা তাদের পড়াশোনার আগ্রহ থেকে তৈরি হয়। ছাত্রদের যেসব যোগ্যতা থাকবে তার মধ্যে রয়েছে-পাবলিকেশন্স, গ্রেড ‘মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড’, অনার্স ও মাস্টার্স।

তিনি আরও বলেন, পিএইচডি সক্ষমতা প্রমাণ করার জন্য আন্তর্জাতিক পাবলিকেশন্স থাকতে হবে। রিচার্স প্রপোজাল (গবেষণা প্রস্তাবনা) দেবে আগ্রহী শিক্ষার্থী। যখন তিনি প্রস্তাবনা দেবেন তাকে পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী হিসাবে সময় দিতে হবে। তিনি চাকরি করলেও সেটি করতে হবে খণ্ডকালীন। তিনি যদি কোথাও চাকরি করেন, তাহলে ছুটিতে থাকবেন। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত নয়।