আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলায় কৌশলী

awami league logo - lig logoডেস্ক রিপোর্ট: বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি না পেলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করবে না এমন অবস্থানে ক্রমেই সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। আর গত নির্বাচনের মত এবারও তারা নির্বাচনসংক্রান্ত ব্যাপারে প্রভাব বিস্তারে তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময় অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মধ্য দিয়ে কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।

ঈদের পর থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তৎপরতা আরো বাড়বে সে চিন্তা মাথায় রেখে যেকোন ধরণের চাপ সুকৌশলে ও শক্তভাবে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।

দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। গত জাতীয় নির্বাচনের আগেও এমনটি হয়েছিল। তাই আন্তর্জাতিক মহলকে সুকৌশলে এবং সচেতনতার সঙ্গে মোকাবেলা করা হবে যেন তারা জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তোলে। ক্ষমতাসীনদের কৌশল- ‘শক্তের ভক্ত, নরমের জম।’ কেউ যেন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেজন্য শক্ত অবস্থানে থাকা এবং অপরদিকে আন্তর্জাতিক মহলের বিভিন্ন প্রশ্ন, শঙ্কার বিষয়ে যুক্তিযুক্তভাবে সঠিক জবাব উপস্থাপন ও সরকারের অবস্থান তুলে ধরে তাদের সন্তুষ্ট করা। এই কৌশল এজন্য যে, কোন দল বা গোষ্ঠী যাতে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। এছাড়া বৈদেশিক শক্তির উপর ভরসা করে কোন রাজনৈতিক দল যেন সহিংসতা তৈরী করতে না পারে সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখবে ক্ষমতাসীনরা।

আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য বৈদেশিক শক্তির কাছে তিনটি ইস্যু রয়েছে- এক. নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, দুই. নির্বাচনকালীন সরকার, তিন. কম গণতন্ত্রের অজুহাত। এছাড়া তারা যে যে ইস্যুতে কথা বলতে চায় এবং বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদলগুলো তাদের যেভাবে সরকারবিরোধী ইস্যুতে কথা বলার সুযোগ করে দেবে সেসব বিষয়ে আগেভাগেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এজন্য দলের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক উপ-কমিটি যথাযথভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে যেন যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করার মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্ট কর যায়।

এই উপ-কমিটি এখন থেকেই পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের অবস্থান তুলে ধরবে। এছাড়া কেউ যেন তাদের ভুল বোঝাতে না পারে সে বিষয়েও পদক্ষেপ নেবে।

এদিকে কয়েকটি দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসকেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে এবং সেইসব দেশের বিভিন্ন প্রশ্ন ও উদ্বেগের বিষয়ে যুক্তির মাধ্যমে সমাধান করতে বলা হয়েছে। এছাড়া সরকার বিরোধী কোন ষড়যন্ত্র হয় কি না সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার মামলা সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সরকারের তরফ থেকে বার্তা দেয়া হচ্ছে খালেদা জিয়ার জেল হবার পেছনে সরকারের কোন হাত নেই; দেশের গতানুগতিক আইন অনুযায়ী এই বিচার হয়েছে। এছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা আওয়ামী লীগ সরকার করেনি; করেছে ১/১১এর তত্ত¡বধায়ক সরকার এবং এ মামলায় খালেদা জিয়া যে নিতান্তই দোষী তার তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হচ্ছে।

এদিকে নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে কূটনীতিকদের বার্তা দেয়া হচ্ছে তাদের দেশ অর্থাৎ আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডাসহ বেশিরভাগ দেশে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও একই পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এক্ষেত্রে তাদের দেশের মত একই আইন ও সংবিধানে যেহেতু বাংলাদেশের নির্বাচন হচ্ছে তাই তাদের এ বিষয়ে চিন্তি হবার কিছু নেই।

আর কম গণতন্ত্রের বিষয়ে কয়েকটি দেশের অজুহাতের বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থেকে আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের দেশে গণতন্ত্র কতটুকু রয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা যা করছে এর চেয়ে বাংলাদেশ অনেক ভালো রয়েছে। তাদের কাছ থেকে গণতন্ত্র শিখতে হবে না। এছাড়া বিগত সময়ে বিএনপির অগ্নি-সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, সহিংসতা তুলে ধরে দলটি থেকে বিভিন্ন দেশের সমর্থন নষ্ট করার প্রচেষ্টা চালানো হবে।

সম্প্রতি ২৩ মে গণভবনে কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ইফতারে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে বার্তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২৮ মে, বাংলাদেশের ‘চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ নিয়ে ঢাকায় দায়িত্বরত বিভিন্ন দেশের অর্ধ-শতাধিক কূটনীতিকদের ব্রিফ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপ কমিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের অধীনে বাংলাদেশের ‘অভূতপূর্ব’ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয় বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে। সেই সঙ্গে তুলে ধরা হয় বিএনপি-জামায়াতের ‘নাশকতার’ তথ্য।

আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, দেশের কিছু বুদ্ধিজীবি ও রাজনীতিক রয়েছেন যারা নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ভূমিকা রেখে থাকেন। বিভিন্ন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ভুল বুঝিয়ে দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে সহযোগীতা করেন। এবার সে দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে দলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। এছাড়া শুধু নির্বাচন নয় কোন বিষয়েই যেন বৈদেশিক শক্তি হস্তক্ষেপ না করতে পারে সে বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থাকবে সরকার। প্রয়োজনে দল ও সরকারের তরফ থেকে নিয়মিত এ ধরণের ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের মাদকবিরোধী অভিযানে নজর রাখার কথা জানিয়ে জাতিসংঘের মাদক অপরাধবিরোধী সংস্থা ইউএনওডিসিও। তারা মাদক নিয়ন্ত্রণে ভারসাম্য ও মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।

এ বিষয়ে কারো চাপে মাথা নত না করার শক্ত অবস্থান তুলে ধরে স্পষ্টভাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণের অধিকার রয়েছে, তা তারা করুক। আমাদের বিদেশি কোনো বন্ধু পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে করুক। কারও চাপের কাছে আমরা নতি স্বীকার করব না, নতি স্বীকার করব বাংলাদেশের জনগণের চাপে।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বলেন, রাজনীতির মাঠে বারবার বিএনপি ব্যর্থ হয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। দেশের বাইরে থেকে লবিস্ট নিয়োগ করে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশকে তারা বিভ্রান্ত করা চেষ্টায় লিপ্ত। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দলটি বৈদেশিক শক্তির উপর ভরসা করছে। তাই কোন ভাবেই বিএনপিকে এ ধরণের সুযোগ দেয়া হবে না।

তিনি আরো বলেন, ‘দেশের অনেক বুদ্ধিজীবি সরকারবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত। তারা বিভিন্ন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদেরকে দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে প্ররোচনা দিচ্ছে। তাদের বিষয়ে তীক্ষè নজর রাখা হচ্ছে।’

এ বিষয়ে দলের আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কর্ণেল (অব.) ফারুক খান বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে, তবে তাদের কোনো চাপ বা প্রভাব থাকার কোনো সুযোগ নেই।
খালেদা জিয়া জেলে থাকলে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকলে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না- এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের কোনো চাপ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের এই নীতিনির্ধারক বলেন, নির্বাচন হবে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলের কার মনেও প্রশ্ন থাকার সুযোগ নেই কারণ এ দেশে যে আইনে নির্বাচন হয়; তাদের দেশেও এই আইনোই নির্বাচন হয়। তিনি বলেন, যদি তাদের কোনো চাপ থাকে তাহলে তা বিএনপির ওপর রয়েছে, সরকারের ওপর নয়। সূত্র: ইনকিলাব