ডেস্ক রিপোর্ট : অবশেষে আগামী মাসে ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে চলেছে নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বেসরকারি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতদের পরিবার। ইউএস-বাংলা এবং তাদের ইন্সুরেন্স কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগস্টের শুরুর দিকে হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়া হবে।
গত ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার একটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হলে ৭১ আরোহীর মধ্যে ৫০ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে চার ক্রুসহ ২৭ জন ছিলেন বাংলাদেশি।
দুর্ঘটনার এক মাস পরে ১১ এপ্রিল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহতদের পরিবার কমপক্ষে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ পাবে।
তিনি আরও বলেন, ওয়ারশ কনভেনশন অনুযায়ী নিহতদের প্রতি পরিবার ইন্সুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে আনুমানিক ৫০ হাজার মার্কিন ডলার করে ক্ষতিপূরণ পাবেন। এজন্য তাদের কিছু আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। আর আহতদের কার কত দিন চিকিৎসা লেগেছে, তার ওপর ভিত্তি করে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া হবে।
নিয়ম অনুযায়ী উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্স ছাড়া চলাচলের সুযোগ নেই। ইন্স্যুরেন্সের আওতায় বিমান, যাত্রী ও পাইলটদের আলাদা ‘মূল্য’ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাইলটদের ১ থেকে ২ লাখ মার্কিন ডলার। আর যাত্রীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫০ হাজার ডলার ইন্স্যুরেন্স সুবিধা থাকে।
এই হিসাবে, নিহত প্রত্যেক যাত্রীর স্বজনদের ন্যূনতম ৫০ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
হতাহতদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কমরুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি, অধিকাংশ নিহত যাত্রীর কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। কোর্টে মামলা ফাইল করা হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যেই তারা ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ পেয়ে যাবেন।’
তবে ওই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত খুলনার আলিফুজ্জামানের ছোট ভাই ইয়াছিন আরাফাত পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর ইউএস-বাংলার ইন্সুরেন্স কোম্পানির আইনজীবী আমাদের পরিবারের কাছে ভাইয়ের মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশান সার্টিফিকেট, ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ বিভিন্ন কাগজপত্র চেয়েছিলেন। আমরা সেগুলো সরবরাহ করেছি। প্রত্যেক মাসেই ইন্সুরেন্সের পক্ষ থেকে বলা হয়, সামনের মাসে ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন। কিন্তু, এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ আমরা পাইনি।’
গাজীপুরের নগরহাওলা গ্রামের একই পরিবারের ৫ জন বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনায় মেহেদী হাসান মাসুম, তার স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, মেহেদীর মামাতো ভাই ফারুক আহমেদ প্রিয়কের স্ত্রী আলমুন নাহার এ্যানি প্রাণে বেঁচে গেলেও মারা যান প্রিয়ক ও তার একমাত্র কন্যাশিশু প্রিয়ন্ময়ী তামাররা প্রিয়ক।
দুর্ঘটনায় আহত মেহেদী হাসান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের আইনজীবীরা যোগাযোগ করেছিলেন। তারা কিছু কাগজপত্র চেয়েছিলেন, সরবরাহ করেছি। কিন্তু, এরপর আর কোনো আপডেট নেই।’
ইন্সুরেন্স কোম্পানি নিযুক্ত এসএম অ্যাসোসিয়েটসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আল আমিন রহমান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নিহত ২৭ বাংলাদেশির মধ্যে ২০ জনের কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৭টি মামলা ফাইল করা হয়েছে। বাকি তিনজনের কাগজপত্রে একটু সমস্যা থাকায় মামলা ফাইল হয়নি। ওয়ারশ কনভেনশন অনুযায়ী ও সরকার ঘোষিত ৫০ হাজার ডলার করে নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে। আহতরাও নিয়ম অনুযায়ী পাবেন।’
তিনি বলেন, ‘যাদের মামলা ফাইল হয়েছে এবং যাদের কাগজপত্র হাতে পেয়েছি, তারা চলতি মাসের শেষের দিকে না হলেও আগস্টের শুরুতে ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়ে যাবেন।’
ক্ষতিপূরণ দিতে দেরি প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আল আমিন রহমান বলেন, ‘বীমা দাবির অর্থ পেতে হলে আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি। এতে কিছুটা সময় লাগে। তাছাড়া হতাহতদের পরিবারের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় নথিপত্র পেতে সময় লাগছে।’
জানা গেছে, উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাংলাদেশে দুটি আন্তর্জাতিক আইনের ধারা অনুসরণ করা হয়। একটি ওয়ারশ কনভেনশন এবং অপরটি মন্ট্রিয়েল কনভেনশন। বাংলাদেশ দুটি কনভেনশনই সই করেছে।
বাংলাদেশ ওয়ারশ কনভেনশনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে ১৯৯৯ সালে মন্ট্রিয়েল কনভেনশনে সই করলেও সেটিকে সংসদে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
ফলে নিহতদের পরিবারকে আপাতত ওয়ারশ কনভেনশন অনুযায়ী ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দেয়া হবে।
এদিকে, মন্ট্রিয়েল কনভেনশন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি করেছেন ওই দুর্ঘটনায় নিহত আঁখি মনির বাবা শফিকুল ইসলাম। কারণ, মন্ট্রিয়েল কনভেনশন অনুযায়ী অর্থের পরিমাণ এক কোটি টাকার বেশি হতো। যেটি ওয়ারশ কনভেনশন অনুযায়ী বেশ কম।
ইউএস-বাংলা উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় আঁখি মনি ও তার স্বামী মিনহাজ বিন নাসের নিহত হন। বিয়ের পর হানিমুনের জন্য নেপালগামী ইউ-এস বাংলার ওই ফ্লাইটে উঠেছিলেন তারা।
আঁখি মনির বাবা শফিকুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘মন্ট্রিয়েল কনভেনশন অনুযায়ী সোয়া লাখ সুইস ফ্রাঁর সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা নিহতের পরিবারের দিতে হবে।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যদি বাংলাদেশ মন্ট্রিয়েল কনভেনশন কার্যকর না করে, তাহলে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স যাত্রীদের কাছ থেকে কীভাবে মন্ট্রিয়েল কনভেনশনের চুক্তি মোতাবেক টাকা নিচ্ছে? সেই চুক্তি না থাকলে তো ওয়ারশ কনভেনশন অনুযায়ী যাত্রীদের কাছ থেকে বীমার টাকা নেয়া উচিত তাদের।’
এ বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কমরুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘মন্ট্রিয়েল কনভেনশন কার্যকরের দায়িত্ব সরকারের। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। প্রতিটা এয়ারলাইন্স যেভাবে চলছে, আমরাও সেভাবে চলছি।’