এক মঞ্চে ড. কামাল-ফখরুল-বি. চৌধুরী-রব-মান্না

এক মঞ্চে উঠলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের- জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার অংশ হিসেবে তারা শুধু এক মঞ্চেই উঠেননি- জানালেন সরকার পতনের অভিন্ন দাবি।

একই সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজানোরও ঘোষণা দেন তারা।

বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে নাগরিক ঐক্য আয়োজিত ‘ইভিএম বর্জন, জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক জোট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর এ তাগিদ দেন পাঁচ দলের এই পাঁচ শীর্ষ নেতা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি. চৌধুরী) বলেন, ‘আজ দেশ সংকটের মধ্যে আছে। দেশে এক ব্যক্তি, একদলীয় শাসন চলছে। দেশের উন্নয়ন করছেন, ভালো কথা। আমরাও উন্নয়ন চাই। উন্নয়নের নামে গণতন্ত্রকে ধাক্কা দেবেন, তা হবে না। জনগণ আর সহ্য করবে না। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র চালাবেন, তা বাংলার মানুষ মেনে নেবে না। হাতুড়ি দিয়ে, বন্দুক দিয়ে জনগণের ওপর হামলা করবেন আর জনগণ সহ্য করবে, তা ভাববেন না।’

তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ছড়াকার আখ্যায়িত করে বলেন, ‘ছড়া লিখুন, বলুন-অসুবিধা নেই। গণতন্ত্রকে ঠিক রাখুন, জনগণের দাবি মেনে নিন’।

বি. চৌধুরীর আরও বলেন, ‘মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন। প্রতিহিংসা পরিহার করুন। আমরা রাজপথে আছি দেশে শ্রদ্ধার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে। প্রতহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। হাতুড়ির রাজনীতি জনগণ চায় না। জনগণ আগামী নির্বাচনে এর দাঁতভাঙা জবাব দেবে’।

তিনি বলেন, এই সরকারের পতনের জন্য আমরা সারা দেশ সফর করব, জনগণের কাছে যাব। সাবেক এই রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া নির্বাচন কমিশন কোনো রকম ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করার ঘোষণা আসতে পারে না। এতেই প্রমাণ হয়, নির্বাচন কমিশন সরকারের ইশারায় চলে। এই নির্বাচন কমিশন বিকলাঙ্গ।

শুরুতেই বক্তব্য দেন ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ গড়তে, স্বৈরাচার হটাতে জনগণের ঐক্য হয়েছিল। আজও সেই রকম একটি বৃহত্তর ঐক্য হতে যাচ্ছে। অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করুন। জনগণ দেশের মালিক। সংবিধানেও সে কথা বলা হয়েছে।’

ড. কামাল হোসেন আরও বলেন, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাই না। দেশের জনগণ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে ব্যবস্থা করতেই হবে। জনগণের দাবি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।’

প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘সামনে আমাদের অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। স্বৈরাচার সরকারের পতনের জন্য আমরা অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছিলাম। সমাজ থেকে অন্যায়কে মুক্ত করতে হবে। দলমত-নির্বিশেষে সংবিধান ও মূল্যবোধের সপক্ষে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে’।

তিনি বলেন, ‘আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যারা আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চায়, তাদের চিহ্নিত করবেন।’

এ সরকারকে জনগণ ‘চায় না’। দ্রুত এই সরকারকে বিদায় করতে হবে- উল্লেখ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের- জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘আসুন, এক মঞ্চে উঠে এই স্বৈরাচার সরকারকে বিদায় করি।’

তিনি বলেন, ‘সংবিধানের প্রতি শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা থাকলে খালেদা জিয়ার মামলার কার্যক্রম জেলখানায় হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার আচরণ করছেন।’

আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহার করে এ দেশে ভোট হবে না। বাংলার জনগণ ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ মানবে না।’

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ১০০ বছরের পরিকল্পনা করছেন। আমার প্রশ্ন, আপনি কত বছর বাঁচবেন? আমাদের এবং জনগণকে বোকা বানাবেন না। এ সরকার ১৬ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই সরকারের আমলে অনেক মামলা হয়েছে, যা পাকিস্তান আমলেও হয়নি।’

আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘বেগম জিয়ার বিচারকাজ জেলখানায় হতে দেয়া হবে না। আমরা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাই। আওয়ামী লীগের ভরাডুবি করতে চাই।’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে’ উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। আসুন দেশ ও জাতির প্রয়োজনে ন্যূনতম কর্মসূচির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হই। দেশকে বাঁচাতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আটকে রাখার জন্য জেলখানায় আদালত বসানো হয়েছে। সরকার আইনের লঙ্ঘন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এ রকম কোনো নজির নেই।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, ‘যেখানে আদালত করা হয়েছে, সেটি ছোট একটি রুম। অন্ধকার। হুইলচেয়ার নিয়ে এসেছেন। বেগম জিয়া বলেছেন, এখানে তিনি আর যাবেন না।’

তিনি বলেন, ‘আজ ফ্যাসিস্ট সরকার গণতন্ত্রের ওপর হামলা করেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে ভৌতিক মামলা করেছে। আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের নির্মমতা দেখেছি। বর্তমান সরকার কি এখন কম নির্যাতন করছে? আসুন, আমরা দলমত-নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি।’

কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনায় বসার সম্ভাবনা সরকারের পক্ষ থেকে নাকচ করে দেয়া হলেও ফের সংলাপের আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা বারবার অনুরোধ করেছি, আসুন দাম্ভিকতা-আত্মম্ভরিতা পরিত্যাগ করে জনগণের জন্য, মানুষের জন্য কথা বলুন, সংলাপ করুন। কথা বলে একটা রাস্তা বের করুন, যেন দেশে একটা সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে’।

কারাগারে আদালত বসিয়ে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার বিচার করার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সংবিধান ও প্রচলিত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ব্রিটিশ আমলে স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেশের জন্য যারা সংগ্রাম-লড়াই করেছিল, তাদের এ ধরনের ক্যামেরা ট্রায়ালে বিচার করা হয়েছিল। আমরা ১৯৭১ সালে দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যামেরা ট্রায়াল করে হত্যা করা হয়েছে। আজকে স্বাধীনতার ৪৮ বছরের পর ক্যামেরা ট্রায়ালের আদালতে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার বিচার করা হচ্ছে।

ড. কামাল হোসেনকে উদ্দেশ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলার সময় বলছিলাম, আপনারা স্বাধীনতাযুদ্ধের সামনে ছিলেন, এই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আপনারা দিয়েছিলেন। আজকে সেই স্বাধীন বাংলাদেশ ডুবে যাচ্ছে, নিমজ্জিত হচ্ছে, একে তোলার চেষ্টা করুন। সবাই মিলে আসুন, আমরা একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বাংলাদেশকে রক্ষা করি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে সারা দেশ থেকে বিএনপির কার্যকরী পরিষদের সদস্যদের ডেকে বলেছিলেন, আমি জানি আমাকে কয়েক দিন পরেই কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। যাওয়ার আগে আমি আপনাদের একটি কথা বলে দিতে চাই, গণতন্ত্রের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য আপনারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম করবেন। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম করবেন। সেখানে তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। আমরা সেই জাতীয় ঐক্যের জন্যই কাজ করছি। আসুন আমরা সব ধর্ম, বর্ণ, মত সবকিছুকে তুলে রেখে আজকে বাংলাদেশকে রক্ষা, দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য, সাংবাদিকদের লেখার অধিকার রক্ষা করার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।

খালেদা জিয়াসহ ‘সকল রাজবন্দিকে মুক্তি’ দেয়ার দাবি তুলে ফখরুল বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮ হাজার মামলা, ১৮ লাখ মানুষ আসামি। এসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

নিরপেক্ষ সরকারে অধীনে নির্বাচন দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে।

ইভিএমে ভোট কেন করতে চান, সে বিষয়ে সরকারকে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এটা সহজে ম্যানিপুলেট (নিজেদের মতো করে ব্যবহার) করতে পারবেন। এটা দিয়ে ১টা ভোটকে ১০টা ভোট করা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘হাজার নেতাকর্মীকে জেলে আটক রাখা হয়েছে। সরকার একটি পাতানো নির্বাচন করার জন্য এই নিপীড়ন নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। আমি আশা করি, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে ফ্যাসিস্ট সরকারের সকল কূটকৌশল ভেস্তে যাবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনো সরকার যদি জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হয়, সে সরকার জনগণের জন্য কাজ করবে। জনগণ দ্বারা নির্বাচিত না হলে সে সরকার কখনো জনগণের জন্য কাজ করতে পারে না।’

তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সংবিধান রক্ষার জন্য। পরে তিনি মিড-টাইম (মধ্যমেয়াদি) নির্বাচন দেবেন। কিন্তু তিনি তার কথা থেকে সরে গেছেন।

সভাপতির বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এই সরকার চোর। এই সরকারকে জনগণ আর চায় না। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শেয়ারবাজার, বনজঙ্গল, পানি, পাথর, কয়লা, জমি-সব খেয়েছে এই সরকার।’

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি কাঁদি। হ্যাঁ, আমি কাঁদি, প্রধানমন্ত্রীকে দেখে কাঁদি। আওয়ামী লীগকে দেখে কাঁদি। আর আমি যদি লিখি, তাহলে চোর বলে লিখতে হবে। লিখতে গেলে শেষ করা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ সরকারকে জনগণ চায় না। জনগণ বোঝে, কাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সিলেটে ত্রাস করেছে, খুলনায় করেছে, রাজশাহীতে করেছে। সিলেটে ত্রাস করেও জিততে পারেনি। জনগণ জবাব দিয়েছে।’

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ইভিএমের জন্য যে এলসি খোলা হয়েছে, টাকা কই? হিসাব নেয়া হবে। সরকারের পতন ঘটাতে হবে। আমরা সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষা নির্বাচন চাই। এই দাবিতে রাজপথে নামব। আমাদের আন্দোলনের মুখে সরকারকে মাথা নত করতে হবে’।