‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি’ সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে: টিআইবি

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ স্বল্পমেয়াদে সরকারের জন্য উপযোগী বিবেচনা করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে ও চূড়ান্ত বিবেচনায় তা বুমেরাং বা আত্মঘাতী হবে বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্তর্নিহিত উপাদান ও সংবিধান বিধৃত মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতার জন্য আইনটিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেও উল্লেখ করেন তারা। সে জন্য সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আইনটিতে এ পর্যায়ে সম্মতি প্রদান না করে বিতর্কিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ধারাসমূহ পুনর্বিবেচনা করার জন্য সংসদে ফেরত পাঠাতে এবং সংশ্লিষ্টজনের মতামত সাপেক্ষে আইনটি সংশোধন করতে রাষ্ট্রপতির প্রতি আবেদন জানিয়েছে টিআইবি।

বুধবার সকালে আন্তর্জাতিক তথ্য জানার অধিকার দিবস ২০১৮ উপলক্ষে আয়োজিত এক মানববন্ধনে টিআইবির পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে আয়োজিত এ মানববন্ধনে টিআইবির কর্মীরা ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত ইয়েস গ্রুপের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে দেশের ৪৫টি সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) অঞ্চলে তথ্য ও পরামর্শ ডেস্ক, মানববন্ধন, র‌্যালি, সেমিনার, দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রদর্শনী ও পথনাটকসহ বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রমের আয়োজন করেছে টিআইবি।

মানববন্ধনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি বেশকিছু আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যার মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা আগের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষুণ্ণ হয়ে আসছে। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার রূপান্তর হিসেবে সম্প্রতি সংসদে অনুমোদিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আইনটি শুধু বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়ই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না, গণমাধ্যমকর্মীসহ বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত বিভিন্ন ব্যক্তি যারা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে গবেষণা করে তার ওপর ভিত্তি করে সরকারকে জবাবদিহিতার জন্য পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছেন, তাদের জন্যও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ঔপনিবেশিক সময়ের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় নতুন করে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত পশ্চাৎমুখী। সাংবাদিক বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য বড় ধরনের হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হবে এ আইনটির ফলে।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল যে সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ ধরনের আইন প্রণয়ন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনটি দেশে গণতন্ত্র বিকাশের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে ও মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করবে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবশ্যই আইনের প্রয়োজন আছে, তবে সে আইন নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির জন্য নয়। আইনটিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নিবর্তনমূলক ধারা অন্তর্ভুক্ত থাকায় মৌলিক অধিকার হরণের ব্যাপক সম্ভাবনার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিশ্চিতের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সেক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ অর্জনে সরকারের পাশাপাশি জনগণ, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকাও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা মানুষের অপরিহার্য অধিকার উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্য অধিকার আইন একটি ব্যতিক্রমধর্মী আইন যা সরকার, জনপ্রতিনিধি ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে জবাবদিহির মধ্যে আনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা প্রদান করেছে এবং এ জবাবদিহি নিশ্চিতের পূর্বশর্ত হলো চাহিদা অনুযায়ী যথানিয়মে তথ্যের প্রদান। আইনটির প্রয়োগে সরকারের উদ্যোগ- যেমন তথ্য বাতায়নের মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত তথ্য জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং এর সাথে তথ্য অধিকার আইনকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্য প্রকাশকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান- প্রভৃতি ইতিবাচক ও উৎসাহব্যঞ্জক। তবে একই সঙ্গে সরকারের নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জক উদ্যোগও লক্ষণীয়।