যেসব গ্রাউন্ডে খালাস চেয়েছেন খালেদা জিয়া

বহুল আলোচিত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কারাগার থেকে তিনি এ মামলায় সাজা থেকে খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। একইসঙ্গে তিনি আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন প্রার্থনা করেছেন আদালতের কাছে।

রোববার দুপুরে খালেদা জিয়ার পক্ষে আবেদনটি করেন ব্যারিস্টার নওশাদ জমির। চলতি সপ্তাহেই এ আপিলের ওপর শুনানি হতে পারে। আপিলে তিনি ২০টি যুক্তি তুলে ধরেছেন। যাতে তার জামিন ও খালাস পাবেন বলে মনে করছেন তার আইনজীবীরা।

হাইকোর্টে আপিল আবেদনকারী মামলার অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড ব্যারিস্টার নওশাদ জমির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন ও খালাস চেয়ে মূল ৪১ পৃষ্ঠার আপিল আবেদন করেছি। ওই আবেদনের সঙ্গে বিচারিক আদালতের ৬৩২ পৃষ্ঠার রায় সংযুক্ত করাসহ ৬৭৩ পৃষ্ঠার নথিপত্র জমা দেয়া হয়েছে। আর আপিলে বেগম খালেদা জিয়ার খালাস এবং জামিনের জন্য ২০টি গ্রাউন্ড তুলে ধরা হয়েছে।‘

যেসব গ্রাউন্ডে খালাস চেয়েছেন খালেদা জিয়া :

১. জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট একটি প্রাইভেট (ব্যক্তিগত দাতব্য প্রতিষ্ঠান)। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপ করেননি এবং এ মামলায় ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন প্রযোজ্য নয়।

২. জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামে হিসাব খোলার আবেদন ফরমে খালেদা জিয়ার স্বাক্ষর থাকলেও তার পদবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ নেই কিংবা তার প্রধানমন্ত্রী পদবির কোনো সিল নেই। এই ট্রাস্টের কোনো হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নাম উল্লেখ নেই। এ ট্রাস্ট তিনি তার ব্যক্তিগত ক্ষমতাবলে পরিচালিত করতেন।

৩. এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণাদি ছিল না। এ মামলায় তাকে ধারণার ওপর নির্ভর করে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রদান করা হয়েছে।

৪. রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা চ্যারিটেবল ট্রাস্টের ফান্ডে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন।

৫. ডা. ফারজানা আহমেদ নামের এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে মামলার অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাকে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষী বা তার কোনো লিখিত বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।

৬. দুদক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং পক্ষপাতমূলকভাবে এ মামলার অভিযোগের অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যা রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মাণ হয়।

৭. কারাগারের ভেতরে স্থাপিত আদালতে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে এ মামলার বিচারকার্য পরিচালনা, সাজা ও দণ্ডপ্রদান করা হয়- যা বেআইনি।

৮. জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট জিয়াউর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যক্তিগত ট্রাস্ট যা ট্রাস্ট আইন ১৮৮২ দ্বারা পরিচালিত হবে বিধায় এর বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা দুদকের নেই।

৯. মামলার ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার সম্পর্কিত বিচারিক আদালতের অনুসন্ধানটি মামলার মূল নথির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

১০. মামলার দালিলিক প্রমাণাদি ও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য এটা প্রমাণ করে যে, মেট্রো মেকার অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেড মামলা সংশ্লিষ্ট ৫টি পে-অর্ডারের আবেদন করেছিল।

১১. মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ৫টি পে-অর্ডার সম্পর্কিত বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য।

এ ছাড়াও আপিল আবেদনের অবশিষ্ট ৯টি গ্রাউন্ড মামলা পরিচালনার স্বার্থে প্রকাশ করতে নারাজ ব্যারিস্টার নওশাদ জমির। তিনি বলেন, ‘মামলাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। মামলা পরিচালনার স্বার্থে অবশিষ্ট গ্রাউন্ডগুলো এখনি প্রকাশ করা সম্ভব না।’

এ যুক্তিতে খালেদা জিয়া খালাস পাবেন কি না-এমন প্রশ্নের উত্তরে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার নওশাদ জমির বলেন, ‘আমরা বিচারিক আদালতের আবেদনটি দেখেছি। পর্যাবলোচনা করেছি। এরপর হাইকোর্টে সাজা থেকে খালাস চেয়ে আবেদন করেছি। আমরা আপিল আবেদনে যেসব যুক্তি তুলে ধরেছি সেগুলো আইন ও বিভিন্ন মামলার রেফারেন্স থেকে নেয়া।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের আপিলটি হাইকোর্ট গ্রহণ করে খালেদা জিয়াকে খালাস দেবেন।’

তবে প্রায় ছয়শ পৃষ্ঠার আপিল হাইকোর্টের বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে কি-না তা নিশ্চিত করেননি নওশাদ জমির।

জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদুকের) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া সাত বছরের দণ্ডের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া আপিল করেছেন। আপিলটি আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শত ভাগ প্রস্তুত খালেদা জিয়ার আপিল শুনানির জন্য।’

রোববার বিকেলে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া সাত বছরের সাজা থেকে খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে এ মামলায় খালেদা জিয়া জামিনের আবেদনও করেন।

২৯ অক্টোবর ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। একই সঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। একই সাজা হয়েছে মামলার অপর তিন আসামিরও।

খালেদা জিয়া ছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন—খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

এদের মধ্যে খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছর কারাদণ্ড পেয়ে কারাগারে রয়েছেন। পরবর্তী সময়ে উভয়পক্ষের আপিলের পর হাইকোর্টে সাজা বেড়ে ১০ বছর হয়। হারিছ চৌধুরী রয়েছেন পলাতক। অপর দুই আসামি দীর্ঘদিন জামিনে থাকলেও সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মুন্না ও মনিরুলকে কারাগারে পাঠানো হয়।

চারজনের বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষণার পাশাপাশি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের টাকায় খালেদা জিয়ার নামে কাকরাইলে কেনা ৪২ কাঠা জমি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন আদালত।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করা হয়। এ ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে মামলাটি করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০১২ সালে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।

২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদাসহ চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করের আদালত। সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হলে দুদকের পক্ষে এ মামলায় যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করা হয়।