ইরানে ‘ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে’ ভূপাতিত বিমানের যেসব তথ্য অজানা

ইরানের রাজধানী তেহরানে কয়েকশ বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। ইউক্রেনের একটি যাত্রীবাহী বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ভূপাতিত করার বিষয়টি অস্বীকার করার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করেছে তারা। অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এই বিক্ষোভ হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তার মাধ্যমে এই “অনুপ্রেরণামূলক” বিক্ষোভের প্রতি তার সমর্থন জানিয়েছেন।

শনিবার, অর্থাৎ দুর্ঘটনার তিনদিন পরে ইরান এই বিমানটিকে “অনিচ্ছাকৃতভাবে” ভূপাতিত করার বিষয়টি স্বীকার করে। ওই দুর্ঘটনায় বিমাটিতে থাকা ১৭৬জন আরোহী ও ক্রুর সবাই নিহত হয়।
ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট পিএস-৭৫২ বুধবার কিয়েভ যাওয়ার উদ্দেশ্যে তেহরানের ইমাম খোমেনি বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। এর কিছুক্ষণ পরই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।

ইরাকের মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরে ওই বিমানটি ভূপাতিত করা হয়।

৩ জানুয়ারি বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানি কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় এই হামলা চালায় ইরান।

বেশ কয়েকজন ইরানি এবং ক্যানাডিয়ানের পাশাপাশি ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান এবং জার্মানি থেকে আসা নাগরিকরা বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া বিমানটিতে ছিলেন।

বিক্ষোভ সমাবেশে কি হয়েছে?
শিক্ষার্থীরা শরীফ ও আমির কবির নামে অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে জড়ো হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।

প্রথমে তারা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে জড়ো হয়। কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ তা বিক্ষোভে রূপ নেয়।

আধা-সরকারি ফার্স নিউজ এজেন্সি এই উত্তেজনায় পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন করতে গিয়ে কিছু বিরল তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটি জানায় যে, এক হাজারের বেশি মানুষ দেশটির নেতাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে এবং সোলেইমানির ছবি ছিঁড়েছে।

শিক্ষার্থীরা বিমানটি ভূপাতিত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের, এবং যারা এই ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার আহ্বান জানিয়েছে।

প্রতিবাদী স্লোগানের মধ্যে ছিল “কমান্ডার-ইন-চিফ পদত্যাগ করুন”। এখানে তারা শীর্ষ নেতা আলি খামেনিকে উদ্দেশ্য করে স্লোগানটি দিয়েছে। এছাড়া “মিথ্যাবাদীদের মৃত্যুদণ্ড দাও” বলেও তারা স্লোগান দেয়।

ফার্স জানিয়েছে যে, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের “ছত্রভঙ্গ” করে দেয়। বিশেষ করে, যারা রাস্তা অবরোধ করে ছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায় যে, বিক্ষোভে টিয়ার গ্যাস ছোড়া হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরাও সরকারের এই পদক্ষেপে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

এক ব্যক্তি টুইটারে লিখেছেন: “আমি আমার দেশের কর্তৃপক্ষ, ঘটনাস্থলে থাকা এবং মিথ্যাবাদী লোকদের কখনই ক্ষমা করব না। ”

তবে সোলেইমানি নিহত হওয়ার পরে তার সমর্থনে গোটা ইরান জুড়ে যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে, সে তুলনায় এই বিক্ষোভ অনেক ক্ষুদ্র।

প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইংরেজি এবং ফারসি দুই ভাষায় টুইট করেছেন: ‘ইরানের সাহসী ও ভুক্তভোগী জনগণ: আমি আমার রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই আপনাদের পাশে আছি এবং আমার সরকার আপনাদের পাশে থাকবে।’

‘আমরা আপনাদের প্রতিবাদ নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছি। আপনাদের সাহস অনুপ্রেরণা দেয়।’

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইরানে বিক্ষোভের ভিডিও টুইট করে বলেন, ‘ইরানি জনগণের বক্তব্য স্পষ্ট। তারা খামেনির দুর্নীতিবাজ শাসন ব্যবস্থা, বিপ্লবী বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ড- আইআরজিসি এর বর্বরতা, সরকারের মিথ্যাচার, দুর্নীতি ও অদক্ষতায় বিরক্ত। আমরা ইরানি জনগণের পাশে আছি যারা আরও ভাল ভবিষ্যতের প্রাপ্য।’

তেহরানের একটি প্রতিবাদে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রব ম্যাকায়ারকে কোন “ভিত্তি বা ব্যাখ্যা ছাড়াই” গ্রেপ্তার করা হয়, যেটা কিনা “আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন”। এর পরে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব ডোমিনিক রাব একটি কড়া বিবৃতি দেন।

আমির কবির বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভ করার জন্য মিঃ ম্যাকায়ারকে আটক করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

রাব বলেছেন যে ইরান “পারিয়া স্ট্যাটাসের দিকে যাত্রা চালিয়ে যেতে পারে … বা উত্তেজনা নিরসনে পদক্ষেপ নিতে এবং কূটনৈতিক পথে এগিয়ে যেতে পারে”।

কীভাবে ইরানের স্বীকারোক্তি প্রকাশ পেল?
তিন দিন ধরে ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বিমানটি ভূপাতিত করার খবর অস্বীকার করে আসছিল।

বরং ইরানের এক মুখপাত্র পশ্চিমা দেশগুলিকে “মিথ্যাবাদী এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জড়িত” বলে অভিযোগ করেছিলেন। তবে শনিবার সকালে রাষ্ট্রীয় টিভিতে পড়া একটি বিবৃতিতে বিমানটি ভূপাতিত করার বিষয়টি স্বীকার করা হয়।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ, যিনি রেভল্যুশনারি গার্ডসের এরোস্পেস কমান্ডার, তিনি ঘটনার ব্যাখ্যা দেন।

তিনি বলেছেন যে একজন ক্ষেপণাস্ত্র পরিচালনাকারী স্বাধীনভাবে একা সব কাজ করেছেন। তিনি বিমানটিকে একটি “ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র” ভেবে ভুল করে ফেলেছিলেন। যেহেতু এমন খবর পাওয়া গেছে যে ইরানের দিকে এ জাতীয় ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে।

জেনারেল হাজিজাদেহ বলেন, “সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তার কাছে ১০ সেকেন্ড সময় ছিল। তিনি আঘাত করা বা না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন এবং এইরকম পরিস্থিতিতে তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

“তিনি যোগাযোগ করতে এবং যাচাই করতে বাধ্য ছিলেন। তবে স্পষ্টতই তার যোগাযোগ ব্যবস্থায় কিছু বিঘ্ন ঘটেছিল।”

জেনারেল হাজিজাদেহ বলেছেন, ভবিষ্যতে এই ধরনের “ভুল” রোধে সামরিক বাহিনী তার ব্যবস্থাগুলি আরও উন্নত করবে।

ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানার পরে তার মনে হয়েছিল, এর চাইতে “তিনি যদি মারা যেতেন”।

জেনারেল হাজিজাদেহ বলেছেন যে বুধবার যা ঘটেছিল সে সম্পর্কে তিনি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছিলেন এবং এত দিন ধরে ইরান কেন জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে গেছে সেটা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।

আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, “হিউম্যান এরর বা মানবিক ত্রুটির প্রমাণ” রয়েছে। এবং প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন ইরান “এই বিপর্যয়কর ভুলের জন্য গভীরভাবে দুঃখিত”।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ এই দোষের কিছু দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরেও ফেলছেন। ‘মার্কিন হঠকারিতার কারণে সৃষ্ট সঙ্কটের মধ্যে মানবিক ত্রুটির ফলে এই বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে,’ তিনি বলেন।

কানাডা এবং ইউক্রেন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে?
শনিবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেনস্কি এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো মিঃ রুহানির সাথে কথা বলেছেন।

ট্রুডো বলেছেন যে তিনি “ক্ষুব্ধ ও ক্রদ্ধ” এবং রুহানিকে বলেছেন যে “এই ধরনের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি কীভাবে ঘটেছে তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অবশ্যই একটি তদন্ত হওয়া উচিত”।

ট্রুডো বলেছিলেন: “যতক্ষণ না আমরা জবাবদিহি, ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রাপ্য বুঝিয়ে দেব ততক্ষণ পর্যন্ত কানাডা বিশ্রাম নেবে না … তারা আহত, রাগান্বিত ও শোকে স্তব্ধ এবং তারা এর জবাব চায়।”

জেলেনস্কি যিনি ওই ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেছেন, তিনি বলেন, “মিঃ রুহানি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে “এই বিমান বিপর্যয়ের সাথে জড়িত সকল ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনা হবে”।

কানাডার এডমন্টন শহরের যেসব বাসিন্দা ওই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, তাদের স্মরণে রোববার শহরটিতে একটি প্রার্থনার আয়োজনে সহায়তা করেছেন পেগাহ সালারি।

তিনি জানান, ইরান সর্বশেষ যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তার অর্থ “এখন এটি দুঃখের চাইতেও বেশি”, বিশেষ করে এখানকার ইরানি-কানাডিয়ান সম্প্রদায়ের জন্য। ওই বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের অনেকেই এই শহরে থাকেন।

তারমধ্যে আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক, শিক্ষার্থী এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

মিসেস সালারি খোলামেলাভাবে ইরান সরকারের সমালোচনাকারী এবয় তাদের প্রতি অবিশ্বস্ত। এখন তিনি ইরানের প্রতিবাদ বিক্ষোভের খবর এমন উৎকণ্ঠা ও আশা নিয়ে দেখছেন।

তিনি বলেন, কানাডার ইরানি প্রবাসীদের মধ্যে কেউ কেউ তেহরানের সরকারকে সমর্থন করছেন, যা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। তবে এই মুহূর্তের মিসেস সালারি এসব নিয়ে ভাবছেন না।

‘এটি কোন রাজনৈতিক বিষয় নয়, অর্থনীতির সাথে এর কোন যোগসূত্র নেই। এই প্রথমবারের মতো কোন মানবিক ট্র্যাজেডি এবং এই নিহত হওয়া সব মানুষ আমাদেরকে আরও কাছে এনেছে এবং কিছু মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে।’ সূত্র: বিবিসি