করোনা ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও সরবরাহটাই মূল চ্যালেঞ্জ

covid 19 vaccine

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন মজুদ, সরবরাহ ও বিতরণের জন্যে সরকার বিদ্যমান ব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মত, বিদ্যমান ব্যবস্থায় এতো বিপুল সংখ্যক ভ্যাকসিন সরবরাহটাই মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

তাদের মতে, ভ্যাকসিন সংগ্রহের পর তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পাঠাতে হবে। সেসময় একে সঠিক তাপমাত্রায় রাখতে হবে। এর জন্যে প্রয়োজন বিদ্যমান সরবরাহ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা।

বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ‘সারা দেশে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভ্যাকসিন সরবরাহ করাটাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।’

তার মতে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করার জন্যে বিশালাকৃতির ‘কোল্ড চেইন’ নেটওয়ার্ক প্রয়োজন। সেসব ভ্যাকসিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সঠিক নিয়মে পৌঁছে দিতে হবে।

‘বর্তমানে দেশে যে ব্যবস্থা রয়েছে তা দিয়ে স্বল্প সময়ে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা সম্ভব না। সরকার আগেই এই ব্যবস্থাটি ভেবে রাখতে পারতো,’ যোগ করেন অধ্যাপক ইজাজ।

‘কোল্ড চেইন’ হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সঠিক তাপমাত্রায় এই জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা মোতাবেক উৎপাদন থেকে শুরু করে মানবদেহে প্রয়োগ পর্যন্ত ভ্যাকসিনকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে গেলে বেশকিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।

বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) ফ্রেমওয়ার্ক রয়েছে। সেখানে হিমাঙ্কের নিচে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ রাখা সম্ভব।

সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, ডব্লিউএইচও ও ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স জিএভিআইয়ের সহায়তায় সেই ফ্রেমওয়ার্কের সক্ষমতা রয়েছে একই সময়ে দেড় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিতরণ করার।

স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের ইপিআইয়ের একজন পরিচালক শামসুল হক বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা মডের্না ও ফাইজারের ভ্যাকসিন নিয়ে ভাবছি না। কারণ, আমাদের ইপিআই কর্মসূচির অধীনে এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও সরবরাহ করার সামর্থ্য নেই। বিদ্যমান ব্যবস্থার উন্নয়নও খুবই ব্যয়বহুল।’

তিনি আরও বলেন, ‘বরং, যেসব ভ্যাকসিন আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা যাবে যেগুলোর ওপর আমরা জোর দিচ্ছি।’

যেহেতু ডব্লিউএইচও এখনো কোনো ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয়নি তাই এর সংরক্ষণ ও সরবরাহ প্রক্রিয়া কী হবে তা জানা যায়নি।

গত ৫ নভেম্বর সরকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে। দেশে বিদ্যমান ‘কোল্ড চেইন’ এর কথা বিবেচনায় নিয়ে সেরামের কাছ থেকে ৩ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা সেই স্মারকে উল্লেখ করা হয়েছে।

বেক্সিমকো ‘কোভিশিল্ড’ নামের এই ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইপিআইয়ের অধীনে সেগুলো সরবরাহ করবে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটিকেই ‘কোভিশিল্ড’ নাম দেওয়া হয়েছে। এটি বিভিন্ন দেশে চূড়ান্ত ট্রায়ালে রয়েছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, এই ভ্যাকসিন আগামী ডিসেম্বরের শুরুতে পাওয়া যেতে পারে।

সমঝোতা স্মারক মতে, এই ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে সরবরাহ করা হবে।

বিভিন্ন ভ্যাকসিনের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন। সেগুলোর জন্যে প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া। যেমন: কোভিশিল্ডের জন্যে প্রয়োজন ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা।

কিন্তু, নিউইয়র্ক-ভিত্তিক ফাইজারের ভ্যাকসিনের জন্যে প্রয়োজন মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। একবার খোলার পর তা দুই দিন ফ্রিজে রাখা যাবে।

আমেরিকান বায়োটেক প্রতিষ্ঠান মডের্নার ভ্যাকসিনের জন্যে প্রয়োজন মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। প্রতিষ্ঠানটি এই তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এটি একবার খোলার পর এক সপ্তাহ ফ্রিজে রাখা যাবে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল রিসার্চ এথিকস কমিটির সদস্য অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ইপিআইয়ের নেটওয়ার্ক খুবই ভালো।’

তিনি আরও বলেন, যেহেতু সব ভ্যাকসিন একই রকম না সেহেতু সেগুলোর সংরক্ষণ প্রক্রিয়াও ভিন্ন। ‘কোল্ড চেইনের বিদ্যমান ব্যবস্থায় মূলত শিশুদের জন্যে ভ্যাকসিন রাখা হয়। এক থেকে দেড় কোটি মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের সাপোর্ট এর মাধ্যমে দেওয়া যেতে পারে,’ যোগ করেন তিনি।

শামসুল হক আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা ছয় ধরনের ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছি। এগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র এক ধরনের ভ্যাকসিন মাইনাস তাপমাত্রায় রাখার প্রয়োজন হয়।’

দেশের প্রতিটি উপজেলায় মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করার সক্ষমতা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

ডব্লিউএইচও’র মতে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের ‍শুরুতে করোনা ভ্যাকসিন নিবন্ধীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

মানবদেহে প্রথম ভ্যাসকিন ট্রায়াল গত মার্চে শুরু হয়। অন্তত ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ দেশে সীমিত আকারে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের করোনাভ্যাকসিন ট্রেকারের তথ্য মতে, গত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আরও অন্তত ১১টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদের মতে, যেসব দেশ ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনের অর্থ দিয়ে রেখেছে তাদেরকে প্রথম ধাপেই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।

অধ্যাপক সায়েদুর বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন গবেষণার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমার মনে হচ্ছে— এখন থেকে ২৪ মাস পরও দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিনের সুবিধা বঞ্চিত থেকে যেতে পারে। যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে।’

সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, দেশে একই সময়ে সবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব না।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে সবাইকে একই সময়ে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব না। দেশে ভ্যাকসিন আসবে ধাপে ধাপে। তাই আমরা ধাপে ধাপে সবাইকে ভ্যাকসিন দিব। এটা তেমন বড় কোনো সমস্যা না।’

স্বাস্থ্যসচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘জনগণের টাকা দিয়েই আমরা ভ্যাকসিন কিনবো। দেশে ভ্যাকসিন আসার আগে আমাদের সঠিক কোল্ড চেইন নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে হবে। যাতে একটি ভ্যাকসিনও নষ্ট না হয়।’