নতুন বছর, নতুন আশা

স্বাগত ২০২১। এখনো কাটেনি মহামারী। অনিশ্চয়তা চারি দিকে। জনজীবনে অস্বস্তি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। সুখবর নেই রাজনীতিতে। সঙ্কট রয়েছে অর্থনীতিতেও। তবুও চিরাচরিত নিয়মে এসেছে নতুন বছর। নতুন বছর মানেই নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন। নতুন বছরে নাগরিক প্রত্যাশায় ভিন্নতা আছে। কারো চিন্তা রাজনৈতিক, কারো অর্থনৈতিক। আবার কারো সামাজিক। সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা নিরাপত্তা, সুশাসন ও গণতন্ত্রের। সাথে যোগ হয়েছে করোনা থেকে মুক্তির বিষয়টি। কার্যত ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় এখন পুরো জাতি। সাধারণ মানুষের প্রধান চিন্তা টিকে থাকা নিয়ে। তারা ভাবছেন বাজারদর, নিরাপত্তাসহ ভালোভাবে বেঁচে থাকার কথা।

২০২০ সাল পুরোটাই কেটে গেল বিশ্বজুড়ে জেঁকে বসা করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রথম করোনা সংক্রমণের ঘোষণা আসে ৮ মার্চ। এই করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কাল মূর্তির উন্মোচন ঘটেছে। করোনা সংক্রমণে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছে বহু মানুষ। মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের নিয়ে আপনজনেরা একের পর এক বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে রোগীকে ভর্তি করাতে পারেননি। চিকিৎসক কিংবা আত্মীয়স্বজনদের অমানবিক রূপটিও প্রকাশ পেয়েছে। সরকার করোনা সংক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। দূরপাল্লার বাস-ট্রেন বন্ধ ছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পোশাক খাত বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। সরকার প্রণোদনা হিসেবে অতি স্বল্পসুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ ঘোষণা করে।

গেল বছরে লেখাপড়ার বিরাট ক্ষতি হয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোথাও পাঠদান করা হয়নি। করোনা সংক্রমণে অনেক মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে মজুরি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকেই ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। ২০২০ সালে ভয়ানকভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের কবল থেকে শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং পূর্ণবয়স্ক নারী কেউই রক্ষা পাননি। ক্ষমতাসীন দলের লোকজন অনেক ক্ষেত্রে ছিলেন অভিযুক্ত। জানা গেছে, করোনাকালে ১১ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিহত করার জন্য ১৮ হাজার মামলা হয়েছে।

করোনা মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ওলটপালট হয়ে গেছে। বেশির ভাগ বড় অর্থনীতির দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ করোনার মধ্যেও কিছুটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে। তা সত্ত্বেও অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে মহামারী করোনা।

নতুন বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল দেখতে চান সাধারণ মানুষ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কথা হয় গৃহবধূ মমতাজ বেগমের সাথে। তার কথা, ‘গেল বছর পেঁয়াজ-আলুর দাম নিয়ে যা ঘটেছে তাতে আতঙ্কিত হয়েছি। মনে হয়েছে বাজারের ওপর কারোর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সিন্ডিকেট করে যেকোনো শক্তিশালী গ্রুপ চাইলে যেন যা কিছু তাই করতে পারে। এটার অবসান চাই।’

নিরাপত্তার বিষয়টিকে মানুষ এখন শুধু আক্ষরিক অর্থে নিরাপত্তা মনে করেন না। তারা এটাকে অনিশ্চয়তার দিক থেকে দেখেন। কাজের নিরাপত্তা, চলাফেরার নিরাপত্তা, ভালো থাকার নিশ্চয়তা এসব দিক তারা বিবেচনায় নেন। নতুন বছরে এসব দিক দিয়ে সবাই ভালো থাকতে চান। ২০২১ সালে উদযাপিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। রাজনৈতিক দলগুলো সেদিকে মনোনিবেশ করেছে।

একাদশ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিপাকে থাকা বিরোধী দলগুলো নতুন বছরে সরকার পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নতুন বছর পরিবর্তনের। ঐক্যবদ্ধ হয়ে দানব সরকারকে সরাতে হবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। নতুন বছর তাদের জন্য বেকায়দার কিছু হবে না, এমনটাই তারা ভাবছেন। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব তারা ধুমধামেই করার পরিকল্পনা করেছে।

পদ্মা সেতুকে সরকারের জন্য ট্রাম কার্ড বলছেন অনেকেই। এ বছরের শেষ নাগাদ এই সেতু উদ্বোধনের চিন্তা করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে মনে করেন অনেকে।

নতুন বছরে করোনার টিকা আশা দেখাচ্ছে ভুক্তভোগীদের। বাজারে আসা করোনা টিকা ন্যায্যভাবে বণ্টনের জন্য সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস চীনে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের বছর পূর্তির একদিন আগে দেয়া বার্তায় শুধু ধনী দেশ নয়, বিশ্বের সব জায়গায় ঝুঁকিতে থাকা লোকজনের জন্য করোনার টিকা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। ডব্লিউএইচওর প্রধান বলেন, করোনা মহামারীর লাগাম টানতে টিকা বড় ধরনের আশা জাগাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বকে রক্ষায় সব জায়গায় ঝুঁকিতে থাকা সব মানুষ যাতে করোনার টিকা পায়, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালটা কেটেছে দুঃস্বপ্নের মতো। নতুন বছরে প্রত্যাশা শিক্ষাব্যবস্থায় যেন আগের মতো গতি ফিরে আসে, শিক্ষার্থীদের যেন সেশনজটে থাকতে না হয়। আরেকটি প্রত্যাশা নারীর নিরাপত্তা নিয়ে। প্রতিনিয়ত নারীকে ঘরে বাইরে সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। যৌন হয়রানি, ধর্ষণ নিত্যদিনের ব্যাপার। নতুন বছরে প্রত্যাশা থাকবে নতুন সমাজের, যেখানে নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবেন। নতুন বছর দেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসুক। ঝরাপাতার মতো পুরাতন বছর শেষে নতুন বছর সবুজ পাতার মতো অঙ্কুরিত হোক জীবন ও সমাজে। ছড়িয়ে যাক প্রতিটি মানুষের জীবনে আশা জাগানিয়া কিরণদ্যুতি।

প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা
এ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খ্রিষ্টীয় নতুন বছরে দেশবাসী, প্রবাসী এবং বিশ্ববাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

নতুন বছরে আমরা একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনা মহামারী বিশ্ববাসীকে এক কঠিন বার্তা দিয়েছে। যতই উন্নত হোক না কেন, একা কোন দেশ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমেই যেকোনো বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা করা সম্ভব। আমাদের সবাইকে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি তারুণ্যের শক্তি ও প্রযুক্তি-জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্বে দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।