বর্ষীয়ান রাজনীতিক খালেদুর রহমান টিটো আর নেই

যশোরের বর্ষীয়ান রাজনীতিক সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটো (৭৬) আর নেই। রোববার (১০ জানুয়ারি) দুপুর একটা ২০ মিনিটে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি মারা যান। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) ডা. নাসির উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মরদেহ তার ষষ্ঠিতলাপাড়ার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এর আগে সকাল দশটার দিকে শারীরিক অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠলে টিটোকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।

তার মেজ ছেলে অ্যাডভোকেট খালিদ হাসান জিউস জানান, ফুসফুসে ইনফেকশনজনিত কারণে তিনদিন আগে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রোববার সকাল দশটার দিকে অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।

খালেদুর রহমান টিটো ১৯৪৫ সালের ১ মার্চ কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম অ্যাডভোকেট হবিবুর রহমান। তিনি একজন এমএ, বিএল ছিলেন। মা মরহুম করিমা খাতুন একজন এমএ, এম-এড ছিলেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে টিটো দ্বিতীয়। বড়ভাই মাসুকুর রহমান তোজো ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডবল অনার্স নিয়ে ফিজিক্সে মাস্টার্স পাশ করেন।

রাজনৈতিক সহকর্মী ও পরিবার সদস্যদের দেওয়া তথ্য মতে, খালেদুর রহমান টিটোর শিক্ষাজীবন শুরু হয় যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৬০ সালে এখান থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকার কায়েদে আজম কলেজ হতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে কারাগারে অবস্থানকালে যশোর এমএম কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে মাস্টার্স করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মাস্টার্স আর শেষ করা সম্ভব হয়নি।

খালেদুর রহমান টিটো রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছেন। ১৯৬৩ সালে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নে সম্পৃক্ততার মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

১৯৬৭ সালে কলেজের লেখাপড়া শেষে করে তিনি বাম ধারার শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তিনি কৃষক আন্দোলন জোরদার করতে কোটচাঁদপুর, মহেশপুর ও কালীগঞ্জ এলাকায় যান। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তার সাথে দলে রাজনৈতিক মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। শ্রেণিশত্রু উৎপাটনের লাইন তিনি মেনে নিতে পারেননি। ফলে এক সময়ে দল থেকে বের হয়ে আসেন। এসময় পুলিশি অভিযানের কারণে তিনি কুষ্টিয়ায় চলে যান। ওই বছরের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আবার ভারতে চলে যান। বাম রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে সেখানে তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। আবার পূর্ব পাকিস্থানেও ঢুকতে পারতেন না। এর কারণ হিসেবে ওই সময় পাকিস্থানি আর্মি তার মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার টাকা।

স্বাধীনতার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলে সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। সাংসারিক ব্যয়ভার বহন করার জন্য তিনি ব্যবসা শুরু করেন ও আব্দুস সামাদ মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের প্রথমদিকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী-ন্যাপ) এ যোগ দেন। ১৯৭৪ সালেই ন্যাপের জেলা সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি ন্যাপের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করেন। নির্বাচনের পর বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। তবে তিনি এই দলে যোগ না দিয়ে ন্যাপের সাথেই থেকে যান। ১৯৮১ সালে ‘গণতান্ত্রিক পার্টি’ গঠিত হলে তিনি এই রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। গণতান্ত্রিক পার্টির স্টান্ডিং কমিটির ১১ সদস্যের মধ্যে তিনি ছিলেন। ১৯৮৪ সালে যশোর পৌরসভার নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ১৯৯০ সালের মে মাসে তিনি শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সরকার পতনের পর ১৯৯১ সালে তাকে জেলে যেতে হয়। ১৯৯১ এর শেষে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদের সঙ্গে তার মতবিরোধ হয়। ওই সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাকে দলকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাকে যশোর সদর আসনে টিকেট না দেওয়ায় তিনি নির্বাচন বয়কট করেন।

২০০৫ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান খালেদুর রহমান টিটোকে তার দলে যোগদানের জন্য আহ্বান জানান। ২০০৬ সালে ১১ জানুয়ারি দেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। ওই সরকার ২০০৮ সালের ২৯ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করলে যশোর থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান সাবেক এমপি আলী রেজা রাজু। কিন্তু কিছুদিন পর রাজুর বদলে খালেদুর রহমান টিটোকে যশোর সদর আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। খালেদুর রহমান টিটো তার প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতা, সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে নির্বাচনে পরাজিত করে যশোর সদর আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭২ সালের ১৮ মে যশোর শহরের চুড়িপট্টির মেয়ে রওশন আরা বেগমের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেছিলেন টিটো। তাদের তিন ছেলে। ২০০৭ সালে স্ত্রী রওশন মারা যান।