পাপুলের পৃষ্ঠপোষকদেরও বিচার চান বঞ্চিত রায়পুরবাসী

অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগে ২০২০ সালের জুনে কুয়েতে গ্রেফতার হন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। বর্তমানে তিনি কুয়েতের কারাগারেই আছেন। গ্রেফতার হওয়ার পর পাপুলের কতিপয় অনুসারী তাকে নির্দোষ প্রমাণে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে সপ্তাহব্যাপী মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা ও সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। যদিও মানবপাচার ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগের মামলায় গত ২৮ জানুয়ারি পাপুলের চার বছর কারাদণ্ড এবং ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার (প্রায় ৫৩ কোটি ২১ লাখ টাকা) জরিমানা হয়েছে।

স্বতন্ত্র এ এমপির এমন সাজাকে সরকারের সংশ্লিষ্টরা যেমন বলছেন লজ্জাজনক, তেমনি পাপুলের নির্বাচনী এলাকা লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের বাসিন্দারাও বিষয়টি বিব্রত এবং লজ্জিত। যদিও তার কর্মকাণ্ডে আগে থেকেই বিক্ষুব্ধ ছিলেন এলাকাবাসী। কারণ, পাপুল তাদের অনেক আশ্বাস দিলেও কোনোটাই পূরণ করেননি। বিদেশের মাটিতে অপরাধের কারণে কারাদণ্ডিত হয়ে দেশ ও জাতির ভাবমূর্তি বিনষ্ট করায় পাপুল এবং তার সহায়তাকারীদের বিচার চান উন্নয়নবঞ্চিত এলাকাবাসী।

২০২০ সালের শুরুতে কুয়েতে মানবপাচারসহ পাপুলের দুর্নীতির বিষয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ পায়। তখন বাংলাদেশে ‘শ্রমিক থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক এমপি পাপুল’সহ বিভিন্ন শিরোনামে ছবিসহ একটি তথ্যবহুল খবর প্রকাশ হয়। পাপুলের স্ত্রী সেলিমা ইসলামও সংরক্ষিত আসনের এমপি। রাজনীতির বাইরে থাকা ‘ভাগ্যবান’ এ দম্পতি টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র ও জেলার দলীয় কিছু সংখ্যক নেতাকর্মীকে নিজেদের পক্ষে ভাগিয়ে নিয়েছিলেন। যদিও লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় পাপুলকে ‘নব্য-হাইব্রিড’ আখ্যা দিয়ে একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

নির্বাচনী এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অল্প সময়ের মধ্যে ‘টাকার সাগর’ হিসেবে রায়পুরে পরিচিতি পেয়েছিলেন পাপুল। তার ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলম। কুয়েতে গিয়েও রাজনীতি ছাড়েননি তিনি। তার হাত ধরে ১৯৯২ সালে কুয়েত যান পাপুল। চতুরতা দিয়ে সেখানে তিনি ‘টাকার সাগর’ বনে যান। গ্রেফতার হওয়ার আগে পাপুল মারাফী কুয়েতিয়া গ্রুপ অব কোম্পানিজের (কুয়েত, ওমান ও জর্ডান) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মামলার অভিযোগ অনুসারে, কুয়েতে প্রতারণার মাধ্যমে ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিকের কাছ থেকে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে ‘রেসিডেন্সি পারমিট’র জন্য দুই হাজার কুয়েতি দিনার বা সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি টাকা নিতেন পাপুল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাপুলের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা পাপুল ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে আসেন। ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর স্থানীয় একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সংবাদকর্মীদের নিয়ে মতবিনিমিয় করেন। ‘জন্মের পর তখনই প্রথম এসেছেন’ জানিয়ে রায়পুরকে জেলায় রূপান্তর করাসহ একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেন পাপুল। এরপর রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জামশেদ কবির বাক্কি বিল্লাহর হাত ধরে তিনি কিছু দান-খয়রাত করেন। অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে ‘দানবীর’ ও ‘মানবতার সেবক’ হিসেবে প্রচার চালান তিনি।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটগত কারণে জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি মোহাম্মদ নোমানকে মনোনয়ন দেয়া হয়। তখন শহীদ ইসলাম পাপুল স্বতন্ত্র (আপেল) প্রার্থী হন। নির্বাচনের এক সপ্তাহে আগে মোহাম্মদ নোমান নাটকীয়ভাবে গা ঢাকা দেন। তখন অভিযোগ ওঠে, পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে নোমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন পাপুল। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে রায়পুর তাজমহল সিনেমা হলের সামনে দলের জরুরি সভায় আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নোমান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।… অনেক টাকা, অনেক টাকা।’

তার এই বক্তব্য নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সভায় নেতাদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা ও হাতাহাতিও হয়েছিল। এরপর এমপি নির্বাচিত হন পাপুল। পরে নিজের স্ত্রী সেলিমা ইসলামের জন্যও বাগিয়ে নেন কুমিল্লার সংরক্ষিত আসনের এমপির পদ। সেলিমা ইসলাম কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা।

টাকা ঢেলে জনসভার মঞ্চে জায়গা নেন পাপুল
২০১৭ সালের ১৪ মার্চ লক্ষ্মীপুর জেলা স্টেডিয়ামে আওয়ামী লীগ সভাপতির জনসভা হয়। তখন অভিযোগ ওঠে, ৫০ কোটি টাকার বিনিময়ে নেতাদের মন জয় করে জনসভা মঞ্চে উঠেছেন পাপুল। যদিও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এম আলাউদ্দিন মঞ্চে স্থান পাননি। তাকে রোদের মধ্যে সামনের মাঠে বসে থাকতে দেখা গেছে। অবশ্য শুরু থেকেই এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের দাবি ছিল, জনসভার খরচের জন্য পাপুল ২০ লাখ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।

আওয়ামী লীগের সভায় পাপুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
শহিদ ইসলাম পাপুল টাকার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় ২-৩ জনের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আশীর্বাদ নেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত তিনি জেলা ও উপজেলা কমিটির সদস্যও নন। রায়পুরে আওয়ামী লীগের একাধিক সভায় তাকে প্রধান অতিথিও করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দলের ত্যাগী একাংশের নেতাকর্মীরা। গত বছর জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় পাপুলকে ‘নব্য-হাইব্রিড’ আখ্যা দিয়ে একাধিক নেতা বক্তব্যও রেখেছিলেন।

নেতাকর্মীদের বশে রাখতে মোটরসাইকেল উপহার
দলে ভিড়তেই রায়পুর উপজেলার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মীকে মোটরসাইকেল দিয়েছেন পাপুল। এর মধ্যে কয়েকজন সংবাদকর্মী ও পেশাজীবী নেতাও রয়েছেন। নেতাকর্মীদের নিজেদের পক্ষে রাখা, নির্বাচনী এলাকায় স্বামী-স্ত্রীকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গাড়িবহরে সঙ্গী করার জন্যই এসব মোটরসাইকেল দেয়া হয়। ১১তম সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে এসব মোটরসাইকেল হস্তান্তর করা হয়।

উড়ে এসে উড়ে চলে যেতেন পাপুল
এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিমাসেই এলাকায় আসতেন শহীদ ইসলাম পাপুল। মাঝে মাঝে দুই-এক রাত তার রায়পুর পৌরসভার কেরোয়ার কাজী বাড়িতেই অবস্থান করতেন। প্রশাসনের সভা ও সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে সকাল-দুপুর হেলিকপ্টারে এসে কাজ সেরে আবার বিকেলেই ঢাকায় ফিরে যেতেন তিনি। পাপুল হেলিকপ্টারে এসে কয়েকটি স্থানে কম্বল বিতরণও করেছিলেন। এ জন্য অনেকেই বলাবলি করেন, ‘পাপুল হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন’।

পাপুলের কাণ্ডে হতাশ উন্নয়নবঞ্চিতরা
লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের) আসনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা পাপুলকাণ্ডে হতাশ। তাদের মতে, নির্বাচনের আগে পাপুল উন্নয়নের অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। জরুরি প্রয়োজনে এমপি কিংবা তার প্রতিনিধিকেও কেউ ফোন দিয়ে পায় না।

রায়পুরের দুজন ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, পাপুল এক সভায় প্রকাশ্যে হাজারো নেতাকর্মীর সামনে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি টাকার সাগর। সাগর থেকে যেমন বালতি কেটে পানি নিলে শেষ হয় না, তেমনি আমার কাছ থেকে আপনারা টাকা নিলেও তা শেষ হবে না’। আরেকদিন বলেছিলেন, ‘সরকার যদি এ আসনের উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়, তাহলে আমিও ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আরও ১০০ কোটি টাকা দিয়ে কাজ করাবো’।

বাস্তবে এসব কথার কোনো বাস্তবায়ন নেই বলে দাবি করেন ওই দুই চেয়ারম্যান।

দালালবাজার এলাকার রিকশাচালক তাহের মিজি বলেন, ‘হুনছি (শুনেছি) বিদেশে এমপি পাপুলের সাজা অইছে। হেতে ভণ্ড। হথমে (প্রথমে) আমগরে কিছু দিছে, ভোটের হরে (পরে) আর কিছুই দেয়নি। আর দেহিও (দেখিও) না।’

প্রজন্ম ৭১- এর রায়পুরের সংগঠক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘পাপুল আমাদের উন্নয়নের অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এসব ছিল তার নাটক। এমপি পদ ব্যবহার করে অপকর্ম করার জন্য তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। লক্ষ্মীপুর তথা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে ছোট করেছেন তিনি। এ ক্ষতি অপূরণীয়।’

লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাসেল মাহমুদ ভূঁইয়া মান্না বলেন, ‘পাপুল বিএনপি নেতা তারেক রহমানের এজেন্ট হিসেবে লক্ষ্মীপুরে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যও নন। হঠাৎ টাকার বিনিময়ে পাপুল সস্ত্রীক এমপি হয়ে এখন আর্ন্তজাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। যারা পাপুলদের অপকর্মে সহযোগিতা করেছেন, তাদেরও বিচার হওয়া প্রয়োজন।’

কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শামছুল ইসলাম পাটওয়ারী বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে আসছি। পাপুল হঠাৎ লক্ষ্মীপুর এসে টাকার বিনিময়ে শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতার ওপর ভর করেছিলেন। পরে নাটকীয়ভাবে স্বামী-স্ত্রী এমপি হয়েছেন।’

জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ফরিদা ইয়াসমিন লিকা বলেন, ‘পাপুল আর পাপিয়ারা আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করছে। টাকার মালিকরা হঠাৎ এসে নেতা এবং এমপি বনে যাচ্ছে, এর চেয়ে আমাদের লজ্জার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতারা এসব পাপুলদের আবিষ্কার করেছেন।’

লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিন বলেন, ‘অবৈধ টাকার বিনিময়ে আমাদের কিছু সুবিধাবাদী নেতা পাপুলকে এমপি বানিয়েছেন। অপরাধ করে শেষ পর্যন্ত কেউ পার পায় না। যারা তাকে সহযোগিতা করেছিল, জনসম্মুখে তাদের মুখোশ উন্মোচন হওয়া উচিত।’