কষ্টে দিন কাটছে চাউলিয়া ঋষিপল্লীর ২ শতাধিক হস্তশিল্পীর

বাঁশ ও বেত শিল্প বাঙালি সাংস্কৃতির একটি বড় অংশ দখলে করে আছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। যুগযুগ ধরে বাঁশ ও বেতের তৈরি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র ব্যবহার করে আসছে মানুষজন। একটা সময় ছিলো বাঁশের চাটাই ও বেতের তৈরি আসবপত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিলো মানব সভ্যতায়।

কয়েক বছর পূর্বেও যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের চাউলিয়া গ্রামের ঋষিপল্লীতে ঘরে-ঘরে বাঁশ শিল্পের কারিকাজের দেখা মিল্লেও এখন আর নেই বল্লে চলে। একেত আধুনিকতার ছোঁয়া ওন্যদিকে অদৃশ্য মহামারী করোনা ভাইরাসের আগ্রাসন সহ বিভিন্ন সমস্যার কারনে এঅঞ্চলের প্রায় ২’শতাধিক হস্তশিল্পীর অধিকাংশই এখন প্রাচীন এই পেশা পাল্টে ফেলেছে।

কালের বিবর্তনে একেত বাঁশ-বেতের তৈরি চাটাই, কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকরি/ঝুড়ি, মাছ ধরা পোলো, ডোল (ধান রাখা পাত্র), চালুনি, মাছ রাখার খালই, হাঁস-মুরগি রাখা খাঁচা ও টেপারি সহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের বিকল্প হিসাবে জায়গা দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক ও আধুনিক পণ্য সমগ্রী।

এমনিতে মানব সভ্যতার পরিবর্তন তার উপর মহামারীর আগ্রাসন সব মিলিয়ে কোনো মতে টিকে থাকার লড়ায়ে চালিয়ে যাছে এঅঞ্চলের গুটি কয়েক হস্তশিল্পী। দীর্ঘ স্থায়ীর চলমান এই মহামারী ভাইরাসে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রয়োজনীয় পুঁজির চরম অভাব।

শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিসহ প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতায় এঅঞ্চল থেকেও এখন বাঁশ শিল্প বিলুপ্তির পথে। বলা চলে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁশ ও বেত শিল্পের ঠিকানা এখন জাদুঘরে বন্দি।

একটা সময় রূপদিয়া এলাকার চাউলিয়া গ্রামের ঋষিপল্লীর বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র উপায় ছিলো বাঁশ-বেতের হস্তশিল্প। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিদিনই চলতো গ্রামীণ এই পল্লী জুড়ে বাঁশের চটা দিয়ে চাটাই বা চাঁচ, কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকরি/ঝুড়ি, চালুনি/চালন, মাছ রাখার খালই হাঁস-মুরগি রাখার খাঁচাসহ গৃহস্থলীর কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস তৈরির প্রতিযোগিতা।

পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে সামিল হতো কাঁধেকাধ মিলিয়ে। প্রত্যেহ সপ্তাহের হাটের দিন গুলোতে স্থানীয় বাজারে পশরা সাজিয়ে চালাতো এসব পণ্য বেঁচাবিক্রি। অনেকে’ই আবার বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়িতে যেয়ে ফেরি করে বিক্রয় করতো নিজেদের তৈরি বাঁশ-বেতের এসব পণ্য। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই শিল্পের মূল উপকরণ বেতের অকাল আর বাঁশের মূল্য বৃদ্ধিতে বাঁশ-বেতের কারিগররা চাইলেও তাদের পেশা ধরে রাখতে পারছেনা।

একারনে এশিল্পের অনেকেই এখন বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকেই আবার সংসার চালাতে এ পেশা ছেড়ে চলে গেছে ওন্য পেশায়। একটা সময় এসব এলাকার বিভিন্ন জনপদে বড় বড় বাঁশ বাগান দেখা মিল্লেও এখন আর সেসব চোখে পড়ে না।

এ বাঁশ দিয়েই বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন বহু মানুষ। নির্বিচারে বাঁশ কড়াল ধ্বংসের কারণে বাঁশের বংশ বিস্তার কমে গেছে বহুগুন। চাউলিয়ার ঋষিপল্লীর কারিগর কার্তিক চন্দ্র দাস বলেন, ‘বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র মানুষ এখন আর আগের মতো ব্যবহার করে না।

কারণ বর্তমানে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পণ্যের উপর ঝুঁকছে মানুষ। ফলে এ শিল্পটি চিরোতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাঁশ-বেত শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের দুর্দিন কাটিয়ে সুদিন ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগই চোখে পড়ে না।

বাঁশ ও বেতে তৈরি বিভিন্ন আসবপত্রের স্থানীয় পাইকারী ক্রেতা আনন্দ দাস জানান, একসময় প্রত্যেক বাড়িতেই বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার ছিল। চাহিদাও ছিল ব্যাপক। বর্তমান প্লাস্টিক পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ আদি শিল্প’টি।

এলাকার বাঁশ শিল্পের কারিগর প্রভাষ দাস, কালাচান দাস ও জগদীশ দাস বলেন, কর্মসংস্থান ও চাহিদা দিনে দিনে সংকুচিত হওয়ায়, আমরা এখন অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছি।

শত প্রতিকূলতার মধ্যে পুরোনো পেশা ধরে রাখতে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রয়োজনীয় পুঁজি আর উপকরণের অভাবে সে প্রচেষ্টা থমকে যাচ্ছে। তাই জাতীর এই বিবেকের মাধ্যমে আমরা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার স্বল্পসুদে ঋণ সহায়তা কামনা করছি।