মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার হবে আর্জেন্টিনার আদালতে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে বিশ্বের যেকোনো স্থানে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের বিচার করার যে অধিকার ‘ইউনিভার্সেল জুরিসডিকশন’ (সর্বজনীন এখতিয়ার) নীতিতে আছে তা প্রয়োগ করতে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা। দেশটির আদালত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
২০১৭ সালে জোরপূর্বক গণবাস্তুচ্যুত হয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ বাংলাদেশে চলে আসে। এর পর থেকেই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ‘ইউনিভার্সেল জুরিসডিকশন’ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
রোহিঙ্গা গণহত্যা বিষয়ে আর্জেন্টিনাই প্রথম ওই নীতি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনার আদালতের সিদ্ধান্তকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল হক।
গতকাল রবিবার তিনি বলেন, আমরা বলে আসছিলাম, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের রায় যদি আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় তবে তা বড় ধরনের ‘গেম চেঞ্জার’ হবে। আইসিজেতে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী আদেশ আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চলে এসেছে।
শহীদুল হক আরো বলেন, আইসিসি, আইসিজের সিদ্ধান্তগুলো নাগরিকত্বের অধিকারসহ রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার পথ দেখাবে। আর্জেন্টিনার সিদ্ধান্ত এই প্রক্রিয়াকে আরো জোরালো করবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক রোহিঙ্গাদের সংগঠন বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের (ব্রুক) সভাপতি তুন খিন গতকাল রবিবার জানান, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ব্রুক প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনায় ওই মামলা শুরুর জন্য আবেদন করেছিল।
আর্জেন্টিনার আদালত সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ও বর্তমান নেতৃত্বের অনেক জ্যেষ্ঠ সদস্যসহ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা শুরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে।
আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের ফেডারেল ক্রিমিনাল কোর্টের সেকেন্ড চেম্বার গত শুক্রবার নিশ্চিত করেছে, ‘ইউনিভার্সেল জুরিসডিকশন’ নীতির আওতায় মিয়ানমারে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তারা মামলা শুরু করবে।
ব্রুক জানায়, আর্জেন্টিনার আদালত ঐতিহাসিক এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ছয়জন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষ্য আমলে নিয়েছেন। ওই নারীরা রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়েছেন। তাঁদের ধর্ষণ এবং তাঁদের স্বামী ও সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে।
তুন খিন বলেন, আর্জেন্টিনার আদালতের এই সিদ্ধান্ত শুধু রোহিঙ্গাদের জন্যই নয়, বিশ্বের যেকোনো স্থানে নিপীড়িতদের জন্য আশার আলো দেখাবে। আর্জেন্টিনার আদালতের ওই সিদ্ধান্তের অর্থ হলো, গণহত্যা সংঘটনকারীরা কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারবে না। ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্তদের জন্য সারা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ।
ব্রুক সভাপতি বলেন, আর্জেন্টিনার আপিল বিভাগের দ্বিতীয় চেম্বার আদালত নিশ্চিত হয়েছে যে মিয়ানমারে সংঘটিত অপরাধের মাত্রা ভয়াবহ, সেগুলো তদন্তের দাবি রাখে।
রাখাইন রাজ্যে অবশিষ্ট রোহিঙ্গারাও ধারাবাহিকভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। ব্রুক বলেছে, আর্জেন্টিনার আদালতের মামলায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত সব ধরনের অপরাধের বিচারিক এখতিয়ার স্বীকার করা হয়েছে।
মিয়ানমার আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের রোম সংবিধির সদস্য না হওয়ায় শুধু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার মধ্য দিয়ে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার রাখে। এদিক থেকে ‘ইউনিভার্সেল জুরিসডিকশনের’ আওতায় আর্জেন্টিনার আদালতের বিচারিক এখতিয়ার বেশি।
ব্রুক এখন রোহিঙ্গা নিপীড়নের আরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিচারকাজে সহযোগিতা করবে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মিয়ানমারবিষয়ক আন্তর্জাতিক তদন্ত কাঠামো থেকেও তথ্য সংগ্রহের পরামর্শ দেবে।