মহেশপুরে গরু ব্যবসায়ীর মৃত্যুর রহস্য নিয়ে ধুম্রজাল, পিটিয়ে হত্যা নাকি দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু?

las

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের পুরন্দরপুর গ্রামের মাংস ব্যবসায়ী সুলতানের মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল।দুর্ঘটনার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশ। এদিকে তার মৃত্যুকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে উঠেপড়ে লেগেছে একটি মহল। নির্দোষ, ঘটনাস্থলে ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের নামেও হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সাথে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করানো হয়েছে।

জানা যায়, গত ৬ জুন সন্ধ্যায় পুরন্দরপুর গ্রামের মাংস ব্যবসায়ী সুলতান পরকীয়া প্রেমিকার বাড়িতে যায়। ঘরের মধ্যে তাদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখে তার ছেলে রহিম স্থানীয়দের খবর দেয়। প্রতিবেশীরা এলে ঐ নারীর দুই ছেলে রহিম ও রাসেল সুলতানকে আটক করে। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে তাদের আটক করার পর ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মিজানুর রহমানকে রাত ১১ টার দিকে ডেকে আনে পরিবারের সদস্যরা। মিজানুর রহমান সুলতানের ভাই ফরিদ ও তার গ্রামের ইউপি সদস্য আরিফুর রহমানকে ডেকে এনে শালিসী বৈঠক করে। একপর্যায়ে ওই নারী ও সুলতান নিজেদের প্রেমের সম্পর্ক আছে স্বীকার করে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। পরবর্তীতে তারা ৩ টার দিকে ফতেপুর ইউনিয়নের কাজী হাফিজুর রহমান এসে হালিমার স্বামীকে তালাক দিয়ে সুলতানের সাথে ওই নারীর বিয়ে দেয়। ভোরে সুলতান তার স্ত্রীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। এ ঘটনার প্রায় ১ মাস আঠারো দিন পর যশোরের একটি ক্লিনিকে পেটের ব্যাথার কারণে ভর্তি হয় সুলতান। সেখানে তার অপারেশন করানো হয়। পরে তার শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চলতি মাসের ৩ তারিখে তার মৃত্যু হয়। সেখান থেকে মরদেহ বাড়িতে আনা হয়। এরপর থেকে শুরু হয় লাশ নিয়ে রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিবারের সদস্যদের দিয়ে মহেশপুর থানায় মরদেহ পাঠানো হয়। সেখান থেকে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। ওই দিনই ইউপি সদস্য মিজানকে প্রধান আসামী করে থানায় হত্যা মামলা করে তার ভাই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলার এজাহারে যেসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে ঘটনার কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন সুলতানকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের কথা বলা হলেও ওই দিন ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে এমন কোন তথ্য জানা যায়নি। এজাহারে খালিশপুর গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসার কথা বলা হলেও ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে ওই দিন তিনি হাসপাতালে আসেনি।

প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশী ইউনুস বলেন, ঘটনার দিন আমি ভাটামতলা বাজারে ছিলাম। খবর শুনে এসে দেখি ওই নারীর দুই ছেলে সুলতানকে ধরে রেখেছে। আমি বলার পর আমার কাছে সুলতানকে দিয়ে দেয়। রাত ১১ টার দিকে যখন শুনি ওরা নিজেদের সম্মতিতে বিয়ে করবে তখন আমি বাড়ি চলে আসি। আমি যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ সুলতানকে কেউ মারধর করেনি। পরেও তাকে মারধর করেনি।

প্রত্যক্ষদর্শী ওই নারীর বোন লাকি খাতুন বলেন, আমি ওই সময় ওখানেই ছিলাম। আমার বোন আর সুলতান যখন বিয়ে করার কথা বলে তখন সবাই রাজি হয়। আমি সকাল পর্যন্ত সেখানে ছিলাম সুলতানকে মারধর করা হয়েছে এমন তো কোন ঘটনা দেখিনি। এমনকি বিয়ে করার পর তারা বাইসাইকেল নিয়ে চলে যায় ভোরবেলা। তাকে যদি মারধরই করা হতো তাহলে সে কি সাইকেল নিয়ে বউ নিয়ে যেতে পারতো। একটুতো অসুস্থ হতো। তা কিন্তু হয়নি।

প্রতিবেশী ইউনুস রাত ১১ টায় ফিরে যাওয়ার সময় সুলতানের ভাই ফরিদ ওই বাড়িতে আসে। ফরিদ এসে তাকে মারধরের কোন ঘটনা দেখেনি।

ফরিদ বলেন, আমার ভাইকে মারধর করা হয়েছে আগেই। আমি যাওয়ার পর দেখিনি। তাকে হয়তো আগেই মারধর করা হয়েছে।

বিয়ে পড়ানো কাজী হাফিজুর রহমান বলেন, আমি রাত ৩ টার দিকে ওই বাড়িতে যায়। সেখানে গিয়ে সুলতান ও ওই নারী উভয়ের সম্মতি ছিলো বিয়েতে। তিনি আরও বলেন, আমি ওইদিন যা দেখলাম তাতে মারধরের কোন আলামত তো পেলাম না। একজনকে মারধর করলে তো কিছুটা হলেও বোঝা যাবে। বিয়ে দেওয়ার পর সুলতান খুব খুশি ছিল। বউ নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।

হাফিজুর রহমান বলেন, বিয়ের দিন সুলতান খুশি ছিল কিন্তু ওই মাসের ২০ তারিখে আমার বাড়িতে সুলতান ও তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার জন্য তার ভাই ফরিদ, মেম্বর আরিফুর রহমান, নজু মেম্বর, কহিনুর, জাহাঙ্গীরসহ আরও কয়েকজন আসেন। সেই দিন সুলতান তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চায়নি। অনেকটা জোর করে তাদের তালাক দেওয়া হয়েছে। আমার দেখা মতে বিয়ের দিন সুলতান যত খুশি ছিল তালাক দেওয়ার দিন তার মন খুব খারাপ ছিলো।

এ ব্যাপারে সুলতানের স্ত্রী ওই নারী বলেন, বিয়ের পর আমাকে নিয়ে সুলতানের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে বাড়ির লোকজন বাড়িতে উঠতে না দিলে আমরা ঢাকায় সুলতানের মেয়ের বাড়ি চলে যায়। সেখানে ১৩ দিন থাকার পর মেনে নেওয়ার কথা বলে আমাদের ডেকে আনে। বাড়িতে আনার পর আমাকে তালাক দেওয়ার জন্য সুলতানকে চাঁপ দেয় তার বাড়ির লোকজন। সুলতান আমাকে তালাক দিতে না চাওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। পরে ২০ তারিখে কাজীর বাড়িতে নিয়ে জোর করে তালাক দেওয়ায়।

তিনি আরো বলেন, আমার সাথে সুলতানের ১৩ দিন সংসার করে। আমাকে সেই সময় বলেছিলো সুলতান দেড় বছর আগে গরুতে তার তলপেটে গুতা দেয়। সেই কারণে মাঝে মাঝে ব্যাথা করত।

স্থানীয় রুস্তম খাঁ বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সুলতানের মৃত্যুকে হত্যা বলা হচ্ছে। দেড় বছর আগে গরুতে তাকে গুতা দেয়। যে কারণে তার পেটে সমস্যা হয়। এ সমস্যার কারণে সুলতান মারা গেছে। আর এটি হত্যা হিসেবে চালাতে চাচ্ছে। যাদের নামে মামলা করা হয়েছে তাদের অনেকেই ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা আছে। তাদের নামেও মামলা করা হয়েছে। মুলত ওই গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন এই ঘটনার মুলে রয়েছে। নির্বাচনে ৪ বার ফেল করার পর মিজান মেম্বরকে ফাঁসাতে এ ষড়যন্ত্র করছে।

এ ব্যাপারে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা: মোঃ সাইদুর রহমান বলেন, সুলতানের পেটে ভেতরে টিউমার ধরনের হয়ে গেছিলো। সেটি পেকে গেছিলো। তিনি বলেন, তাকে নাকি গরুতে গুতা দিয়েছে এমন কথা তার মেয়ে আমাকে বলেছিল। তাকে মারধর করা হয়েছে এমন কথা তার মেয়ে বলেনি।

এ ব্যাপারে মহেশপুর থানার ওসি সেলিম মিয়া বলেন, একটি মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। মৃত্যুর মুল ঘটনা জানতে আমারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। মামলায় যদি নির্দোষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবে তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। তখন তাদের মামলা থেকে বাদ দেওয়া হবে।