নিষ্পত্তির অপেক্ষায় দেড় যুগ গ্রেনেড হামলা মামলা  

 

২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারকাজ ১৮ বছরেও শেষ হয়নি। মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি উচ্চ আদালতে অপেক্ষমাণ প্রায় চার বছর। পেপারবুক তৈরি হলেও কবে নাগাদ শুনানি শুরু হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ। ফলে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দ্রুত মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। এদিকে সাজাপ্রাপ্ত ৫২ আসামির মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৬ জন এখনো পলাতক। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে।

 

এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত তৎপর। সবাই জানেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার কতদিন পর শুরু হয়েছে। আবার বিচার করতে গিয়ে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছে। এ কারণে অধস্তন আদালতে বিচার শেষ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এটি এখন উচ্চ আদালতে আছে। শিগগিরই এই মামলার আপিল শুনানি শুরু হবে। তিনি বলেন, এই মামলার সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক আসামিদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতকদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চেষ্টা করছে সরকার।

 

অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, মামলার পেপারবুক তৈরির কাজ শেষ। করোনার কারণে বেশ কিছুদিন সুপ্রিমকোর্টে স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। আশা করছি, মামলাটি শিগগিরই শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন মারা যান। আহত হন কয়েকশ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। আহতদের অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই এ সংক্রান্ত মামলার বিচার শুরু হয়। ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এসে এর অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপির নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর দুই অভিযোগপত্রের ৫২ আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্য মামলায় মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় তাদের ছাড়াই বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

 

২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দীন, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তদন্তে বেরিয়ে আসে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে।

 

১৪ বছরের মাথায় পৃথক দুটি মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় বাকি ১১ জনের। পলাতক ছিলেন ১৮ জন। পরে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি ইকবাল হোসেনকে রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে আর মুফতি আব্দুল হাইকে চলতি বছরের ২৫ মে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর মামলার বিচারিক আদালতের রায়ের প্রয়োজনীয় নথি হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছে।

 

মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা : বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়। শুরু থেকেই নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা করা হয়। ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে অনেক তথ্য। জজ মিয়া নামের এক নিরীহ ব্যক্তিকে আটক করে তার কাছ থেকে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করে ঘটনার প্রকৃত কুশীলবদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে তদন্ত শুরু করলে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য।