রুদ্ধশ্বাস এক রাত শেখ হাসিনার

PM hasina

 

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, শনিবার। আওয়ামী লীগের ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় অফিসের চারপাশে শান্তিপ্রিয় অসংখ্য মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। হঠাৎ শক্তিশালী গ্রেনেডের বিস্ম্ফোরণ। ১৩টি গ্রেনেডের ভয়াবহতায় আকস্মিক মৃত্যুর আস্ম্ফালন। রক্তস্রোতে ভেসে গেল অসংখ্য মানুষ। চারদিকে মানবদেহের ছিন্নভিন্ন টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

 

মৃত্যুর ওই আঙিনায় দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল সবার একটিই জিজ্ঞাসা ছিল, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কোথায়? তিনি বেঁচে আছেন তো!’ হন্যে হয়ে কমবেশি সবাই আওয়ামী লীগ সভাপতির গাড়ির খোঁজ করতে থাকেন। খানিক পরই যেন কানে এলো দৈববাণী- ‘মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেছেন শেখ হাসিনা। তাঁকে সুধা সদনের বাসভবনে নেওয়া হয়েছে।’ অশুভ শক্তির বিভীষিকাময় ওই শক্তিশালী গ্রেনেড হামলার আগমুহূর্তে ট্রাকমঞ্চ থেকে ভাষণ দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা নজিব আহমেদ ছিলেন ঠিক পেছনে। তিনি সেদিনের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে সমকালকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতির সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষ হওয়ার পরও ফটোসাংবাদিকদের অনুরোধে আরও কিছুক্ষণ ভাষণ দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। ওই সময়েই বিকট শব্দে একের পর এক বিস্ম্ফোরিত হয় কমপক্ষে ১০টি তাজা গ্রেনেড।

 

 

আর সঙ্গে সঙ্গেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে ছুটে আসেন নজিব আহমেদ। তখন উচ্চ স্বরে কলেমা তৈয়্যবা ও দোয়া ইউনুস পড়ছিলেন শেখ হাসিনা। আর বলছিলেন, ‘সবাই আল্লাহকে ডাকেন। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমাদের বাঁচানোর কেউ নেই।’ ওই সময়ে মুহূর্তের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ঘিরে মানবঢাল তৈরি করেন ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, নজিব আহমেদ ও আবদুল্লাহ আল মামুন।

এ সময় ট্রাকমঞ্চের সিঁড়ির গোড়ায় গাড়ি নিয়ে আসেন মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তখন আরেক দফায় গ্রেনেড হামলায় স্প্নিন্টারের আঘাতে তারিক আহমেদ সিদ্দিক, নজিব আহমেদ ও আবদুল্লাহ আল মামুনের শরীর রক্তে ভিজে যায়। তাঁরা সেটা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনাকে মঞ্চের ওপরে বসিয়ে রাখেন। একপর্যায়ে গ্রেনেড হামলা বন্ধ হলে নিচে নেমে আসেন শেখ হাসিনা। তিনি গাড়িচালক আবদুল মতিনের পাশের আসনে গিয়ে বসেন। পেছনে দুইজনের আসনে গাদাগাদি করে বসেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, তারিক আহমেদ সিদ্দিক, নজিব আহমেদ, আবদুল্লাহ আল মামুন ও মেজর (অব.) সোয়েব।

 

এরপর গাড়ি ছুটে চলে সুধা সদনের উদ্দেশে। নজিব আহমেদ জানান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, জিপিও, শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার, আবদুল গনি রোড, হাইকোর্ট, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, আজিমপুর, নিউমার্কেট ও পিলখানা হয়ে সুধা সদনে পৌঁছে শেখ হাসিনাকে বহন করা গাড়ি। ওই সময়ে সুধা সদনের নিচতলায় ড্রয়িংরুমে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা। আওয়ামী লীগ সভাপতি সুধা সদনে পৌঁছেই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের হাতে কিছু টাকা দিয়ে যে কোনো মূল্যে দলের আহত নেতাকর্মীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।

নজিব আহমেদ জানালেন, ওই রাতের সারাটা ক্ষণ জেগেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। রাতের খাওয়াও হয়নি তাঁর। সারাক্ষণই তিনি আহত নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসা করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। ওই সময়ে মাঝেমধ্যেই আহত নেতাকর্মীদের মৃত্যুসংবাদ আসছিল। আর সেটা শুনে গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। সারাটা রাত তিনি অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন। কখনও দোতলায় গেছেন, আবার ফিরে এসেছেন নিচতলার ড্রয়িংরুমে। আওয়ামী লীগ সভাপতির মতো তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীদেরও নির্ঘুম রাত কেটেছে ওই দিন। সুধা সদনেও হামলার আশঙ্কায় তাঁদের সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতির ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম গ্রেনেড হামলার পূর্বক্ষণে শেখ হাসিনার গাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বললেন, ভয়ংকর গ্রেনেড হামলার টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। জীবন বাজি রেখে তাঁকে বাঁচিয়েছেন তাঁরই প্রিয় সহকর্মী-সহমর্মীরা। শেখ হাসিনাকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ। জাহাঙ্গীর আলম জানালেন, প্রথম গ্রেনেডটি বিস্ম্ফোরিত হয়েছিল ট্রাকমঞ্চ থেকে নামার সিঁড়িতে। ওই সময়ে ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কি ও মোহাম্মদ আলমের অনুরোধে আওয়ামী লীগ সভাপতি বক্তৃতারত না থাকলে তাঁর ওপরই গ্রেনেডটি বিস্ম্ফোরিত হতো।