বড় দলের ‘ভয়ে’ সহনশীল, নতুনের জন্য কঠোর ইসি

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পেতে একটি দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সর্বস্তরের কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ে সহযোগী বা অঙ্গসংগঠন থাকার সুযোগ নেই। যে কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হতে ওই এলাকার সংশ্নিষ্ট দলের তৃণমূল কমিটির প্যানেল থেকে মনোনয়ন দেওয়ার বিধান রয়েছে।

২০০৮ সালে এসব শর্ত মেনে নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ দলের বিরুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে এই আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও ইসি নির্বিকার। গত ১৩ অক্টোবর নিবন্ধিত দলগুলোকে চিঠি দিয়ে এসব শর্ত পালনের বিষয়ে ইসিকে অবহিত করতে ৩০ কার্যদিবস সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তবে ইসি সূত্র জানিয়েছে, ২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩৯ দলের মধ্যে ২৩টি ইসিকে সে তথ্য সরবরাহ করেছে। বিএনপিসহ তিনটি দল এসব তথ্য দিতে ইসির কাছে অতিরিক্ত সময় চেয়ে আবেদন করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বাকি ১৩টি দলের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এর আগেও কাজী রকিবউদ্দীন ও কে এম নূরুল হুদা কমিশনের পক্ষ থেকেও একাধিকবার এমন চিঠি দেওয়া হলে তাতে সাড়া মেলেনি। যদিও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ (আরপিও) অনুযায়ী এসব বিধি লঙ্ঘনের দায়ে সংশ্নিষ্ট দলের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে ইসির হাতে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বড় দলগুলোর কেউই নিবন্ধনের শর্ত মেনে দল পরিচালনা করছে না। এ জন্য তিনি ইসিকে দায়ী করে বলেন, আইনের প্রয়োগ একটি বড় বিষয়। ২০০৮ সালে এই বিধান চালু হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়নে অনেক ক্ষেত্রেই তৃণমূল থেকে প্রস্তাব নিয়ে মনোনয়নের চর্চা শুরু করেছিল। বিএনপি শুরু থেকেই এটি উপেক্ষা করে চলছে। বর্তমানে ইসির চোখের সামনেই তৃণমূলের প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়নের বিধান লঙ্ঘন চলছে। নিকট অতীতে প্রায় সব স্থানীয় সরকারের ভোটে প্রার্থী মনোনয়নে ছিল প্রকাশ্য টাকার খেলা। কিন্তু ইসিকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আরপিও অনুযায়ী ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন রাখার সুযোগ নেই। দেশের বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাখা এখনও চালু রয়েছে। বড় দলগুলোর নেতারা এসব সংগঠনকে অনেকটা প্রকাশ্যেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

 

তাঁর মতে, কমিশন পরিচালনায় যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন তাঁদের যোগ্যতার অভাবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। বড় দলগুলোকে এসব শর্ত মানতে বাধ্য করার মতো পদক্ষেপ নিতে ইসি ভয় পায় বা সাহস রাখে না।

এ বিষয়ে জানতে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, নিবন্ধিত দলগুলো শর্ত পালন করছে কিনা সে বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য পাওয়ার পর কমিশন যাচাই করবে। যাচাই করার মতো সক্ষমতা ইসির আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইসির সে সামর্থ্য যে একেবারে নেই তা নয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিশনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এগুলো খতিয়ে দেখা হবে।

২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম আইনে যুক্ত করা হয়। কোনো দল ইসিতে নিবন্ধিত না হলে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। এ নিবন্ধন পেতে আইনে নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে হয়। আবার নিবন্ধন পাওয়ার পর নির্ধারিত কিছু শর্ত পালন করার বিধান আছে।

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসি ঘোষিত রোডম্যাপে বলা আছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইসি এ তথ্যগুলো সংগ্রহ করবে। তবে দলগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য সরবরাহ করার জন্য সময় আবার বাড়ানো হবে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

নিয়ম সবার জন্য সমান নয়: নবম সংসদের পর থেকে প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে আসছে ইসি। এবারেও ইসির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৯৩টি দল আবেদন করেছে। তবে ইসি-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, গত দুই কমিশন যে প্রক্রিয়ায় আবেদন বাছাই করেছে; এবারেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। ফলে আবেদনকারীদের অধিকাংশই প্রাথমিক বাছাইয়ে বাদ পড়তে যাচ্ছে। হাতেগোনা ৫ থেকে ৭টি দল নিয়ে মাঠ পর্যায়ে যাচাইয়ে নামার প্রয়োজন হতে পারে। তবে কমিশন নতুন দলের আবেদনের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হওয়া খুবই কঠিন হবে। এসব দলের নেতারা বলছেন, নিবন্ধন আইনের শর্তগুলো পূরণ করা খুবই কঠিন।

আরপিও অনুযায়ী, তিনটি শর্তের যে কোনো একটি পূরণ করলে কোনো দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সুযোগ আছে ইসির হাতে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে- স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত যে কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে কমপক্ষে একটি আসনে জয়ী হতে হবে। যে কোনো একটি আসনে দলীয় প্রার্থী মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ ভোট পেতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কার্যালয়, অন্তত ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হবে।

ইসি-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে নতুন দলের জন্য আবেদন করা ৯৩টি দলের প্রাথমিক বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি দল যথাযথভাবে আবেদন ফরম পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবেদনপত্রের সঙ্গে ৫ হাজার টাকার চালানের কপি যুক্ত করার বিধান অনেকেই মানেনি। বেশ কয়েকটি দল আবারও গত কমিশনের আমলে আবেদনের সময় জমা দেওয়া পুরোনো চালানের কপি জমা দিয়ে আবেদন করেছে। অনেক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। কোনো দলের নেই গঠনতন্ত্র। কোনো দল নিবন্ধনের নূ্যনতম শর্ত পূরণের দালিলিক প্রমাণও আবেদনের সঙ্গে জমা দেয়নি।

ইসির সংশ্নিষ্ট শাখা কর্মকর্তারা বলছেন, এবারে নিবন্ধনযোগ্য দলের সংখ্যা অনেক কম। যাচাই-বাছাইয়ে অধিকাংশ দল বাদ পড়তে পারে। তবে বাদ দেওয়ার আগে কাগজপত্র সংশোধনের জন্য সংশ্নিষ্ট দলগুলোকে ১৫ দিন সময় দেবে কমিশন। নিবন্ধন বিধিমালা অনুযায়ী, আবেদনে অন্তত ৯ ধরনের তথ্য পূরণ করতে হয় এবং সেসঙ্গে ১০ ধরনের দলিলপত্রের সংযুক্তি দেওয়া বাধ্যতামূলক।

ইসি গঠিত নিবন্ধনের আবেদন বাছাইসংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছেন, আবেদন পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ের কাজ শেষ হতে পারে। তিনি জানান, আইন-বিধি মেনে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে আরও কিছু সময় লাগবে।

নতুন দলকে নিবন্ধন দিতে কঠোর অবস্থানে ছিল কমিশন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আলমগীর। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আইনের শর্ত না মেনে কোনো দল নিবন্ধন পাচ্ছে না। এখানে সহানুভূতির কিছুই নেই। সংবিধানে সংগঠন করার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইসি আলমগীর বলেন, সংবিধানের আলোকে আইন করা হয়েছে। কমিশনকে আইন অনুসরণ করতে হবে। ইসির পক্ষ থেকে আইন শিথিলের উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, এটা রাজনীতিবিদ ও সংসদের কাজ। ইসির নয়।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, এর আগে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনের মেয়াদে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট) এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ইসির নিবন্ধন পায়।

পরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কে এম নূরুল হুদা কমিশনের সময় ৭৬টি রাজনৈতিক দল আবেদন করলেও ইসি কাউকেই বিবেচনা করেনি। পরে আদালতের নির্দেশে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম ও বাংলাদেশ কংগ্রেস নিবন্ধন পায়।

নবম সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পাওয়া দলগুলোর মধ্যে পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা না দেওয়ায় বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। আদালতের রায়ে বাতিল হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন। এ ছাড়া জাতীয় গণতান্ত্রিক দল-জাগপা, প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক পার্টি-পিডিপি ও ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন ইসির নিবন্ধন হারিয়েছে। দীর্ঘদিন ইসির পক্ষ থেকে এই তিন দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া না পাওয়ায় তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছিল।