ফ্রান্সের ফিউজ গ্রিজম্যান

 

জানতেন, তাঁকে ছেলেটি ভীষণ সম্মান করেন; তার পরও দ্বিধাগ্রস্ত মনেই সকালে নাশতার টেবিলে রুটিতে বাটার মাখতে মাখতেই কথাটি পেরেছিলেন দেশম, ‘আচ্ছা, তোমাকে যদি নিচে নামিয়ে আনি। মানে, আমি বলতে চাচ্ছি মাঝমাঠে। তুমি ভালো করবে।’ চমকে গিয়েছিলেন গ্রিজম্যান, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে মজা করছ? আমি পারব না।’ দুই বছর পর্যন্ত সেখানেই চাপা ছিল ওই পর্ব। এরপর বিশ্বকাপের আগে আগে হঠাৎই যখন পল পগবা, এনগোলো কান্তে আর করিন্তিন তোলিসে চোটে পড়েন- তখন যেন মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে দেশমের। আবার তিনি গ্রিজম্যানের হোটেলের দরজায় টোকা মারেন; আবার সেই প্রস্তাব। কিন্তু এবার আর তাঁকে ফেরাতে পারেননি গ্রিজম্যন। সারাজীবন উইঙ্গার অথবা সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলা গ্রিজম্যান হয়ে যান কাতার বিশ্বকাপে ফ্রান্সের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার। জার্সি তার ৭ নম্বরের থাকলেও আদতে তিনি ভূমিকায় ৬ ও ৮ নম্বরের। মজা করে প্যারিসের কিছু দৈনিক তাঁর জার্সি নম্বর দিয়েছে ‘৯.৫’। মিডিয়া সেন্টারে গল্পের মতোই গ্রিজম্যানের এই বদলে যাওয়ার কাহিনি বলছিলেন ফরাসি সাংবাদিক জুলিয়ান লঁরে। তাঁর কাছেই শোনা, দেশের এই সোনার সংসারে এমবাপ্পে নয়, বড় ছেলের ভূমিকাতে গ্রিজম্যানই। যিনি প্রয়োজনে মাঠের যে কোনো শূন্যস্থান পূরণ করতে যেমন পারেন, তেমনি টিম হোটেলের পার্টিতে ডিজেও হতে পারেন। এককথায় গ্রিজম্যানই হচ্ছেন ফরাসি পাওয়ার হাউসের ‘ফিউজ সার্কিট’। এমবাপ্পে নয়, গোটা ফ্রান্স দলকেই অন্ধকারে ফেলা যেতে পারে, যদি এই ফিউজ সার্কিট কাট করতে পারে আর্জেন্টিনা।

দলকে এভাবে উজ্জীবিত করা গ্রিজম্যানকে তাই কিছুটা মিশেল প্লাতিনি আর কিছুটা জিনেদিন জিদানের মিশ্রণও মনে করছেন কেউ কেউ। ১৯৯৮ বিশ্বকাপজয়ী জিদানেরই সতীর্থ ক্রিস্টোফার ডুগরে তাঁদেরই একজন। ‘আমি তো ছেলেটির মধ্যে প্লাতিনি আর জিদানের মিশ্রণ খুঁজে পাই। জিদানের মতো সে সঠিক সময়ে সঠিক পাস দিতে পারে; আবার প্লাতিনির মতো সে ম্যাচের সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারে। প্লাতিনির একটা ভিশন থাকত, তিনি যেমন সবার আগে সবকিছু বুঝে যেতেন এবং নিতেন, গ্রিজম্যানও ঠিক তাই।’ এই গ্রিজম্যানকেই তো দেশম চান। সে কারণেই যখন বার্সেলোনায় খারাপ সময় যাচ্ছিল, তখন দেশমের কাছেই পরামর্শ চেয়েছিলেন গ্রিজম্যান। নিজেকে ভেঙে গড়ার মতো চ্যালেঞ্জ সেখান থেকেই পেয়েছিলেন। গত বিশ্বকাপে চার গোল করা খেলোয়াড়টি এবার গোলশূন্য। তাতে অবশ্য এতটুকু আফসোস নেই তাঁর। ‘নতুন এই ভূমিকায় আমি যথেষ্ট স্বাধীনতা পাই। ডিফেন্স আর ফরোয়ার্ডের সঙ্গে বলের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়াই আমার কাজ। সামনে আমার তিন সতীর্থ থাকে, সে জন্য আমার কাজটিও সহজ। আমি জানি, দলের জন্য আমাকে কোথায় প্রয়োজন। কোচ দলের সেরা কম্বিনেশন নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তা ছাড়া নতুন ভূমিকায় আমার শরীরও ফিট করে। এখন পর্যন্ত দলের জন্য কিছু করতে পারছি, তাতেই আমি সবচেয়ে খুশি।’ ক’দিন আগেই স্বদেশি সাংবাদিকদের সামনে নতুন গ্রিজম্যান তাঁর নতুন অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন। তিনি নাকি এটাও জানিয়ে দেন, দেশমের জন্য তিনি জার্সি নম্বর বদলে ফেলতে পারেন।

বিদেশফেরত ছোট ছেলে অনেক অর্থবিত্ত থাকতে পারে এমবাপ্পের মতো, কিন্তু নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে গ্রিজম্যানের মতো আত্মত্যাগী বড় ছেলে বোধ হয় খুব একটা পাওয়া যায় না। আর সেটা পাওয়াতেই বদলে গেছে ফ্রান্স। ‘তার মধ্যে সব ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাঁর ভিশন, তাঁর ওয়ার্ক রেট, তাঁর টাচ, তাঁর এনার্জি আর সবকিছুর পর তাঁর ইন্টেলিজেন্সি।’ গ্রিজম্যানের কথা উঠতেই অনেক বিশেষণে চলে যান দেশম। কেননা আর কেউ না বুঝুক, তিনি তো বোঝেন- ফরোয়ার্ডের জায়গা ছেড়ে দিয়ে কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁর ‘ফিউজ সার্কিট গ্রিজম্যান’।