উকিল আবদুস সাত্তার, রুমিন ফারহানা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের ‘বিচিত্র’ উপনির্বাচনে প্রার্থী না হয়েও আলোচনায় বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। দলীয় নির্দেশে সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেও উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিএনপি থেকে বহিস্কার হওয়া উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার ‘প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী’ তিনিই। আগামীকাল বুধবারের ভোটে তাঁদের অঘোষিত মূল লড়াই।

রুমিন ফারহানার কারণে দলে কোণঠাসা হয়ে বিএনপির সঙ্গে ৪৩ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়ে উকিল সাত্তার ভোটে অংশ নিচ্ছেন- এমন প্রচার রয়েছে। তাঁর পক্ষে আদাজল খেয়ে ভোটে নামা আওয়ামী লীগ নেতাদের আক্রমণের লক্ষ্যও রুমিন ফারহানা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করা হয়েছে।

রুমিন ফারহানার অনুসারীরা ভোটের মাঠে না থাকলেও উকিল সাত্তারের জয় ঠেকাতে সব রকম চেষ্টা করছেন। উকিল সাত্তারকে জেতাতে আওয়ামী লীগের সব আয়োজন থাকলেও তাঁর ‘কলার ছড়া’ ঠেকাতে জাতীয় পার্টির লাঙ্গলে ভোট দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে বিএনপি সমর্থকদের। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিএনপি থেকে বহিস্কার হওয়া আবু আসিফ আহমেদের লাপাত্তা হওয়ার পেছনেও রুমিন ফারহানাকে টেক্কা দেওয়ার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে।

স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ- দুই দলের নেতারাই জানান, বয়সজনিত কারণে উকিল সাত্তার আগামীতে আর দলীয় মনোনয়ন পাবেন না- তা নিশ্চিত ছিল। রুমিন ফারহানার মনোনয়ন নিশ্চিত থাকায় উকিল সাত্তারের ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী মাইনুল হাসান তুষারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়ে। উকিল সাত্তার দলের এমপি থাকা অবস্থাতেই উপজেলা কমিটি থেকে বাদ পড়েন তুষার। ছেলের ভবিষ্যতের স্বার্থে উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন উকিল সাত্তার। রুমিন ফারহানার নাম উল্লেখ না করলেও তুষারের বক্তব্যে স্পষ্ট- বিএনপির রাজনীতিতে তাঁর পরিবারকে কোণঠাসা করেছে ‘হাইব্রিডরা’। সে কারণেই বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন উকিল সাত্তার। গত রোববার তিনি বলেন, তাঁর বাবাকে বারবার অপমান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সম্মান দিয়েছে। তবে তিনি ও তাঁর বাবা আওয়ামী লীগে যোগ দেননি।

বিএনপির সিদ্ধান্তে দলটির সাত এমপি পদত্যাগ করেন। উকিল সাত্তারের সঙ্গে একই দিনে পদত্যাগ করেন সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে এমপি প্রার্থী হতে তাঁরা দু’জনেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। সে সময় রুমিন ফারহানাকে বাদ দিয়ে চারবারের এমপি উকিল সাত্তারকে বেছে নেয় বিএনপি। দলটির জেতা ছয় আসনের একটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২। পরে সংরক্ষিত আসনে এমপি হন রুমিন ফারহানা।

 

১৯৭৯ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি হন উকিল সাত্তার। ২০০১ সালে জোটের কারণে তাঁর বদলে মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে প্রার্থী করেছিল বিএনপি। পরে উকিল সাত্তারকে করেছিল প্রতিমন্ত্রী। ৮৪ বছর বয়সী এ নেতা ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এলাকায় নিয়মিত নন। সংসদেও ছিলেন নিষ্প্রভ। বিপরীতে রুমিন ফারহানা কড়া বক্তব্যের কারণে আলোচনায় আসেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘উকিল সাত্তারের কী পারফরম্যান্স ছিল এলাকা ও সংসদে; আর আমার কী পারফরম্যান্স- তা সবাই দেখেছে।’

আশুগঞ্জ ও সরাইলে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ এক সময় উকিল সাত্তারের হাতে থাকলেও তা এখন রুমিন ফারহানার কবজায় চলে গেছে বলে অভিমত স্থানীয় নেতাদের। আশুগঞ্জ বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির মুন্সী সমকালকে বলেন, উকিল সাত্তার একাদশ নির্বাচনের পর এলাকায় খুব একটা আসেননি। কাজও করেননি। রুমিন এমপি হিসেবে পাওয়া বরাদ্দে দলীয় নেতাদের দিয়ে এলাকায় কাজ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি ভিত্তি গড়েছেন। তিনি দলের ভবিষ্যৎ।

শারীরিক অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে নীরব উকিল সাত্তার। উপনির্বাচনের প্রচারে যোগ দিলেও বক্তৃতা করেননি। তবে তাঁর হয়ে ভোট চাইতে কমতি রাখছেন না আওয়ামী লীগ নেতারা। তাঁকে জেতাতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি। দলটির তিন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও সরে যান। জাতীয় পার্টির দু’বারের সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধাও সরে গেছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন টানা কয়েক দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উকিল সাত্তারের প্রচার চালিয়েছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। যাঁরা ছিলেন তাঁরাও বসে পড়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারি দল হয়ে তো নির্বাচন বর্জন করতে পারে না। প্রার্থী না থাকায় উকিল সাত্তারকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে।’

‘উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া সমর্থক গোষ্ঠী’র ব্যানারে আয়োজিত ভোটের সভাগুলো থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা উকিল সাত্তারের প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে বেশি আক্রমণ করছেন রুমিনকে। ২০ জানুয়ারি আশুগঞ্জে দলীয় কার্যালয়ে সভা করে জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে রুমিনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। কেন এই ঘোষণা- এ প্রশ্নে আহমদ হোসেন বলেন, এটি হয়তো স্থানীয়ভাবে করা হয়েছে। আর উকিল সাত্তার ও রুমিন ফারহানা এক রকমের মানুষ নন। রুমিন ফারহানারা ভোটে সন্ত্রাস করতে পারে।

তবে অবাঞ্ছিত ঘোষণার আগেই ১৫ জানুয়ারি রুমিন ফারহানা আশুগঞ্জে এসে উপনির্বাচন বয়কটের ডাক দেন। উকিল সাত্তারকে ঠেকানোর বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি কাউকে প্রতিহত করার কথা বলেনি। সাধারণ ভোটার, বিএনপি নেতাকর্মীর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কারণ নেই।

চার প্রার্থীর ভোট থেকে সরে যাওয়া এবং এক প্রার্থীর খোঁজ না মেলায় উকিল সাত্তারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে রয়েছেন স্বল্প পরিচিত জাতীয় পার্টির আবদুল হামিদ ভাসানী ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম। তবে প্রচার চালাচ্ছেন ভাসানী। ২০০৮ ও ‘১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সমর্থিত জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিয়াউল হক মৃধা। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

উকিল সাত্তারকে জেতাতে উপনির্বাচনে ‘সব ব্যবস্থা’ করা হয়েছে। তাই নির্বাচন করে লাভ নেই- এ কারণ দেখিয়ে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও প্রার্থী হননি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া। বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ভোট বয়কট করে লাভ নেই। উকিল সাত্তার এমপি হয়ে যাবেন। তাই তাঁকে ঠেকাতে প্রয়োজনে লাঙ্গলে ভোট দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে কর্মী-সমর্থককে। তবে নেতারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। ইতোমধ্যে অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতা এলাকা ছেড়েছেন।

তিন আওয়ামী লীগ নেতা সরে যাওয়ায় উকিল সাত্তারের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন আশুগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ। তিনিও উকিল সাত্তারের মতো বিএনপি থেকে বহিস্কৃত। পুলিশ ও বিএনপি সূত্রের ভাষ্য, উকিল সাত্তারের জয় নিশ্চিতে আসিফের ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। উকিল সাত্তারকে সমর্থন দিয়ে সরে গেলে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে পড়ত এই ধনাঢ্য নেতার। রুমিন ফারহানার শক্ত অবস্থানের কারণে দলে ফিরতে পারতেন না; মনোনয়নও পেতেন না। লাপাত্তা হওয়ায় বিএনপিতে আসিফ আহমেদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হচ্ছে। নিজেকে নির্যাতিত দাবি করে ভবিষ্যতে দলীয় রাজনীতিতে জায়গা তৈরি করতে পারবেন।