কোহলিময় দিনেও ওয়াংখেড়ে প্রকম্পিত ‘শামি, শামি’ চিৎকারে। ম্যাচ শেষে ওয়াংখেড়ের সাজঘরে দেখা গেল, তার সোনায় মোড়ানো হাতে চুমু খাচ্ছেন সতীর্থ রবিচন্দ্রন অশ্বিন। গত পরশু রাতে নিউজিল্যান্ডকে ৭০ রানে হারিয়ে এক যুগ পর ভারত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এখন সবচেয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত চরিত্র মোহাম্মদ শামি। ভারতের সমর্থকরা বলছেন, ‘এটা শামি-ফাইনাল!’ এই সমর্থকরাই অতীতে বহুবার তার ধর্মীয় পরিচয় ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়েন সামনে এনে শামির দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সমালোচনার কাঁটাকে প্রশংসার ফুল বানাতে দীর্ঘ এক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ৩৩ বছর বয়সি ভারতীয় পেসারকে।
সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শামির ৫৭ রানে সাত উইকেট বিশ্বকাপে তো বটেই, ভারতের ওয়ানডে ইতিহাসেই সেরা বোলিং। বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচে সাত উইকেট নেওয়া প্রথম বোলার শামি। প্রথম বোলার হিসাবে এক বিশ্বকাপে তিনবার পাঁচ উইকেট নিলেন তিনি। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ চারবার পাঁচ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডও এখন শামির। এবারের আসরে মাত্র ছয় ম্যাচেই শামি নিয়েছেন সর্বোচ্চ ২৩ উইকেট। ভারতের বোলারদের মধ্যে যা এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড।
তিন আসর মিলিয়ে বিশ্বকাপে ১৭ ম্যাচে শামি নিয়েছেন ৫৪ উইকেট। বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্রুততম ৫০ উইকেট শিকারি বোলারও তিনি।
ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে এমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের পরও ওয়ানডেতে ১০০ ম্যাচের মাইলফলক ছুঁতে শামির লেগে গেল ১০ বছর! বুধবারের সেমিফাইনাল ছিল তার শততম ওয়ানডে। এতদূর আসতে প্রতি পদক্ষেপে তাকে হোঁচট খেতে হয়েছে। উত্তর প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা শামির স্বপ্ন ছিল, একদিন দেশের হয়ে খেলবেন। কিন্তু জাতীয় দল তো বহুদূর, রাজ্য দলেই সুযোগ পাচ্ছিলেন না তিনি। বাধ্য হয়ে তাকে পাড়ি জমাতে হয় পশ্চিমবঙ্গে। গল্পের বাকি অংশ সবারই জানা। তবে ২০১৩ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পরও মসৃণ হয়নি তার চলার পথ। এই বিশ্বকাপেও যেমন টিম কম্বিনেশনের খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে প্রথম চার ম্যাচে শামিকে
খেলায়নি ভারত। তবে হার্দিক পান্ডিয়ার চোটে কপাল খুলে যাওয়ার পর নিজেকে নতুন করে চেনানোর সুযোগ দুই হাতে লুফে নেন শামি। বেঞ্চ থেকে এখন তিনি ভারতের পেস
আক্রমণের সেনাপতি, সমর্থকদের নয়নের মণি।
শামি সেই ধ্রুপদি ঘরানার বিরল পেসার, বল দুদিকেই সুইং করানোর ক্ষমতা যার সহজাত। তার সিম পজিশন নিখুঁতের কাছাকাছি, যা অনেক অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও জেদের ফসল।
প্রিয় শিষ্যকে ভারতের জাতীয় হিরোর মসনদে দেখে গর্বিত শামির শৈশবের কোচ মোহাম্মদ বদরউদ্দিন বলেন, ‘তার সিম পজিশন, সুইং ও নিখুঁত ডেলিভারি অবশ্যই সহজাত দক্ষতা। কিন্তু এসব শানিত করতে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। শামির সাফল্য অধ্যবসায়ের পুরস্কার।’
সুইংয়ের সুলতান বলা হয় যাকে, পাকিস্তানের সেই কিংবদন্তি পেসার ওয়াসিম আকরামও মজেছেন শামিতে, ‘আমি এত ভালো সিমে বল করতে কাউকে দেখিনি। শামিকে ঘুম থেকে তুলে বল করালেও হয়তো এভাবেই বোলিং করবে। এককথায় অবিশ্বাস্য। শামির সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো সে নতুন বলের পাশাপাশি পুরোনো বলেও সুইং করতে পারে। বল আরও পুরোনো হলে শুরু হয় রিভার্স সুইং।’ প্রশংসার সুনামিতে ভাসলেও শামির পা আছে মাটিতেই। তার ধ্যান-জ্ঞান এখন ১৯ নভেম্বরের ফাইনালে আরেকটি ম্যাজিক শো দেখিয়ে ভারতকে তৃতীয় বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দেওয়া। বলেছেন, ‘অনেক বড় সুযোগ এটি। গত দুই বিশ্বকাপে আমরা সেমিফাইনালে হেরেছি। এবার সুযোগ পেয়েছি, ফাইনালে উঠেছি। আর কখনো সুযোগ আসে কি না কে জানে। এবারই তাই কাজে লাগাতে হবে।’