‘বন্ধু শাহিনের পরিকল্পনায়’ খুন এমপি আনার

কলকাতায় নৃশংসভাবে সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার (৫৭) হত্যাকাণ্ডের পেছনে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম এসেছে তারই বন্ধু আখতারুজ্জামান শাহিনের।

সোনা চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসায় বিরোধের জেরে আজিমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন শাহিন।

আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শাহিনের সঙ্গে পাঁচ কোটি টাকার চুক্তি হয় চরমপন্থি নেতা আমানউল্লাহ আমানের।

আমেরিকান পাসপোর্টধারী শাহিন কলকাতায় বসে হত্যার চূড়ান্ত ছক এঁকে বাংলাদেশে চলে আসেন।

 

পরে আমানসহ ছয়জন মিলে এমপি আজীমকে সঞ্জীবা গার্ডেন নামের একটি ফ্ল্যাটে ট্র্যাপে ফেলে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন। পরে মরদেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ট্রলিব্যাগে ভরে ফেলা হয় অজ্ঞাত স্থানে।

এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ আমানউল্লাহ আমান, মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। তবে পালিয়ে গেছেন শাহিন।

 

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, শাহিন বাংলাদেশ থেকে নেপাল, দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন।

গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আমান জানিয়েছেন, এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহিন। হত্যাকাণ্ডের আগে তাকে কিছু টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল হত্যাকাণ্ডের পর।

 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরের বোনের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন আমান। সেখান থেকেই তাকে আটক করা হয়েছে।

 

সূত্র জানায়, গত ৩০ এপ্রিল শাহীন চরমপন্থি নেতা আমান ও বান্ধবী সিলিস্তি রহমানকে নিয়ে কলকাতা যান। সেখানে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। কলকাতায় আরও আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন শাহীনের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

 

হত্যার পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে গত ১০ মে দেশে চলে আসেন শাহিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমান বাংলাদেশ থেকে আরও দুই ভাড়াটে কিলারকে নিয়ে যান কলকাতায়। ফয়সাল ও মোস্তাফিজ নামে দুই ভাড়াটে খুনি ১১ মে কলকাতায় গিয়ে আমানের সঙ্গে যোগ দেন।

 

আমানকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এমপি আনার যে ১২ মে কলকাতায় যাবেন তা আগে থেকেই জানতেন শাহীন। তাকে হত্যার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেন তার গ্যাংকে। তারা একাধিক চাপাতিও সংগ্রহ করে রাখে।

 

গত ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান আজিম। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পরদিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউটাউনের সেই ফ্ল্যাটে কৌশলে ডেকে নিয়ে যান হত্যাকারীরা।

 

বিকেলের দিকে এমপি আনার সঞ্জীবা গার্ডেনের সেই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। এরপর আমান তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ মিলে এমপিকে চাপাতির মুখে জিম্মি করেন। এ সময় তারা এমপির কাছে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের কথাও বলেন। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করেন। হত্যার পর আমান বিষয়টি জানান শাহিনকে।

 

আমানের দেওয়া তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, শাহীনের পরামর্শ মতো মরদেহ গুম করতে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর ফ্ল্যাটের কাছেই শপিংমল থেকে আনা হয় দুটো বড় ট্রলিব্যাগ ও পলিথিন। এমপি আনারের মরদেহের টুকরোগুলো পলিথিনে পেঁচিয়ে ট্রলিব্যাগে ভরা হয়। ঘটনার রাতে মরদেহের টুকরোসহ দুটি ট্রলিব্যাগ বাসাতেই রাখা হয়। এর মধ্যে তারা বাইরে থেকে ব্লিচিং পাউডার এনে ঘরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করেন।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, কলকাতা পুলিশ ওই ফ্ল্যাট ও আশপাশের ভবনের সব সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আমান ও তার সহযোগীদের ট্রলিব্যাগ আনা-নেওয়া, এমপি আনারের বাইরে রাখা জুতা ভেতরে নেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। এছাড়া সিলিস্তি রহমান নামে শাহীনের বান্ধবীর বাইরে থেকে পলিথিন ও ব্লিচিং পাউডার নিয়ে আসার দৃশ্যও সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আছে।

 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমানের স্বীকারোক্তি ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের পরদিন বিকেলে একটি ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হন আমান।

 

জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে তিনি জানান, বাসা থেকে বের হয়ে পাশের একটি শপিংমলের সামনে সেই ট্রলিব্যাগটি সিয়ামের হাতে তুলে দেন। সিয়াম সেই ব্যাগ নিয়ে তাদের আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা গাড়ি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যান।

 

তবে সেই গাড়িচালক কলকাতা পুলিশকে জানান, সিয়াম কিছুদূর যাওয়ার পর ব্যাগটি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন।

 

লাশের টুকরো আরেকটি ব্যাগে ছিল। সেই ব্যাগ থেকে দুর্গন্ধও ছড়ানো শুরু করেছিল। সেই ব্যাগটি সহযোগীদের অন্য কোথাও ফেলে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ১৫ মে সিলিস্তিকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন আমান।

 

গত ১২ মে ভারতের কলকাতায় চিকিৎসার জন্য গিয়ে পরিকল্পিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার (৫৭)।

 

হত্যা করা হয়েছে এমন আলামত পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চিকিৎসার প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার পর কলকাতার বরাহনগরে পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে প্রথম উঠেছিলেন আনার। আনার নিখোঁজ হওয়ার পর গত ১৮ মে কলকাতার বরাহানগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন গোপাল বিশ্বাস।

 

বরাহনগর থানার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সুবেন্দু গোস্বামীকে উদ্ধৃতি করে সংবাদমাধ্যমকে গোপাল বিশ্বাস জানান, সংসদ সদস্য আনার হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড একজন বাংলাদেশি আমেরিকান আখতারুজ্জামান। যিনি কলকাতায় এসেছিলেন আমেরিকার পাসপোর্ট ব্যবহার করে। এ আখতারুজ্জামান কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন এক বছর আগে। যার ভাড়া এক লাখ রুপি।

 

গোপাল বিশ্বাস আরও জানান, আখতারুজ্জামান বাংলাদেশের ঝিনাইদহের কোট চাঁদপুরের বাসিন্দা। তার সঙ্গে সংসদ সদস্য আনারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশ থেকে সাতজনের সহযোগিতা নিয়ে এই আখতারুজ্জামান সংসদ সদস্য আনারকে হত্যা করে থাকতে পারেন। ওই সাতজনের মধ্যে রয়েছেন, ফয়জুল, মোস্তাফিজুর ও একজন নারী।

 

বুধবার (২২ মে) পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, আনোয়ারুল আজিমকে খুন করা হয়েছে বলে আমরা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছি। কিন্তু তদন্তে এসে শনাক্ত করা ফ্ল্যাটে তার মরদেহ পাইনি।

 

অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, ওই সংসদ সদস্য সন্দীপ রায় নামের এক ব্যক্তির ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরে চাকরি করেন।

 

তিনি ফ্ল্যাট ভাড়া কাকে দিয়েছিলেন, জানতে চাইলে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা আখতারুজ্জামান শাহিন নামের এক ব্যক্তিকে।

 

ঘটনার দিন চারজন আখতারুজ্জামানের ফ্ল্যাটে যান। সিসিটিভিতে দেখা গেছে, তিনজন বেরিয়ে এসেছেন, শুধু আজিম ছাড়া।

 

আনার হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ মোটিভ সম্পর্কে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শাহিন ও সংসদ সদস্য আনারের মধ্যে হুন্ডি ব্যবসা ও স্বর্ণ ব্যবসাকেন্দ্রিক বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জেরে তিনি খুন হয়ে থাকতে পারেন।

 

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, আসলে এটা কী কারণে ঘটেছে জানতে আমাদের তদন্ত চলছে। এটা পারিবারিক নাকি আর্থিক, অথবা এলাকায় কোনো দুর্বৃত্ত দমন করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে কি না, সবকিছু আমরা তদন্তের আওতায় আনবো।

 

তিনি আরও বলেন, এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড মনে করেই তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন। নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সব কিছু বলতে পারছি না।

 

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেছেন, তিনি বাবা হত্যার বিচার চান।

 

বুধবার (২২ মে) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে অবস্থিত ডিবি কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমি আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই। আমার বাবাকে যারা হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে, এটা আমি দেখতে চাই। আমরা কাউকে সন্দেহ করছি না। তবে বাবাকে যারা হত্যা করেছে তাদের আমি দেখতে চাই।

আজিম হত্যায় দুই দেশে দুই মামলা

খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেছে সংসদ সদস্য আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদ আলী বলেন, অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

 

অন্যদিকে একই ঘটনায় কলকাতার নিউটাউন থানায় বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছে কলকাতা পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে সন্দেহে একটি গাড়িও আটক করেছে কলকাতা নিউ টাউন পুলিশ। বুধবার নিউ টাউন থানার সামনে গাড়ির ভেতর থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে ফরেনসিক টিম। গাড়ির মালিক সেটি ভাড়ায় ব্যবহার করতে দিয়েছিল বলে জানা গেছে।