যশোর রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে দুদকের অভিযান, ঘুষ-দুর্নীতির বরপুত্র জেলা রেজিস্ট্রার আবু আলেব

যশোর জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। আজ বুধবার দুপুরে দুই দফা অভিযান চালায় দুদক। অতিরিক্ত ঘুষ নেওয়ার হাতেনাতে প্রামাণ পেয়েছে দুদক।
প্রথম দফা দুপুর ১২টার দিকে দুদুকের একটি টিম অভিযান চালায়। দুদকের নিজস্ব পোষক পরে সহকারী পরিচালক মো: আল আমীন, উপসহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযানে অংশ নেয়। প্রায় দুই ঘন্টা অভিযান চালিয়ে ২টার দিকে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলে রেজিস্ট্রার অফিস ত্যাগ করেন। এর প্রায় ২০ মিনিট পর ফের ওই কার্যালয়ে দ্বিতীয় দফা অভিযান শুরু করে। এরপর প্রায় দেড় ঘন্টা ঘরে রেস্ট্রিার আবু তালেবের রুমে রুদ্ধতার বৈঠক করেন। সেখানে রেজিস্টি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
অভিযান সম্পর্কে সহকারী পরিচালক আল আমীন জানান, যশোর রেজিস্ট্রি অফিসে বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়ে আমাদের কাছে অভিযান আসে। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অভিযান চালায়। অফিস সহকারী ভৈরব চক্রবর্তীর ডয়ার থেকে আমরা বেশ কিছু টাকা জব্দ করেছি। সেখান দুটি জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে। দুটি জমি থেকে এক হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। যেটা ভৈরব চক্রবর্তী স্বীকার করেছে। আমরা এ বিষয়ে ঢাকায় অবহিত করবো। তারপর আইনগত ব্যবস্থা নেব।
এদিকে, যশোর জেলা রেজিস্ট্রার অফিসটি দীর্ঘদিন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। জেলা রেজিস্ট্রার আবু তালেব যোগদানের পর থেকেই টোকাইদের মত সব ক্ষেত্র থেকে ঘুষ আদায় করছেন। রক্ষা পাচ্ছে না অফিসের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে (এক মোহরার) তার কতিথ ক্যশিয়ারে পরিণত করার পর থেকে জেলা রেজিস্ট্রিটি অফিসটি অনিয়ম-দুর্নীতি, ঘুষ-বাণিজ্য ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। শার্শা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের মোহরার শামসুজ্জমান মিলনকে জেলা রেজিস্ট্রার কথিত ক্যাশিয়ার বানিয়েছেন।
৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও জেলা রেজিস্ট্রার আবু তালেব কোন পরিবর্তন হননি। উল্টো প্রতিনিয়ত ঘুষ-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। অফিসের নয়জন কর্মচারীকে অভ্যন্তরীণ বদলি করে অন্তত; ২০ লাখ টাকা ঘুষ-বাণিজ্য করেছেন।
সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমশিন দুদক অনেক আগে থেকে জেলা রেজিস্ট্রার আবু তালেবের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি-ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ চলমান রয়েছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই জেলা রেজিস্ট্রারের অনিয়ম-দুর্নতি, ঘুষ-বাণিজ্য।
সূত্র জানায়, জেলা রেজিস্ট্রার শুধু মাত্র নামে থাকেন। তার সকল অনিয়ম-দুর্নীতির টাকা আদায় করেন মোহরার শামসুজ্জামান মিলন। মিলনই জেলা রেজিস্ট্রার এমন হুংকার দিয়ে থাকেন। মিলনের বিরুদ্ধে হাজার অভিযোগ থাকলেও সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করে চলেন জেলা রেজিস্ট্রার। সম্প্রতি মিলন সদ্য বদলি সদর সাব রেজিস্ট্রার আমিনা বেগমকে দিয়ে অবৈধভাবে এদটি দললি সম্পাদনার চেষ্টা করেন। এতে ব্যর্থ হয়ে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
সূত্র জানায়, সদ্য বদলি যশোর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার আমিন বেগমকে লাঞ্ছিত করেন মোহরার মিলন। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে জেলা রেজিস্ট্রারের বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন সাব রেজিস্ট্রার আমিন বেগম। কিন্তু তিনি প্রতিকার পাননি উল্টো তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। মিলনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করা হলেও জেলা রেজিস্ট্রার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। পরবর্তীতে সাব রেজিস্ট্রার আমেনা বেগম যশোর থেকে বদলি হয়ে যান।
সূত্র জানায়, জেলা রেজিস্ট্রার আবু তালেব ২০২৩ সালের ১২ জুন এখানে যোগদানের পরই শুরু করেন নানা অনিয়ম-দুর্নীতি। ভূমির দলিল নিবন্ধন সেবায় সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট হয়ে পড়ে। দেশের আইন অনুযায়ী কোনো জমি কেনার পর তার দলিল নিবন্ধন করতে হয়। কিন্তু বাধ্যতামূলক এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে গিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয় নিবন্ধনের জন্য আসা মানুষদের। মানুষ যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে তার জন্য জেলা রেজিস্ট্রার তার চাহিদা মত ঘুষের রেট নির্ধারণ করে দেন। তিনি প্রতি দলিল থেকে ১০০ টাকা কোন দলিল থেকে ২০০ টাকা টাকা নির্ধারণ করেন। আর এই ঘুষের টাকা তিনি সাব রেজিস্ট্রারদের দিয়ে আদায় করেন।
আবু তালেব যশোরে যোগদানের পরই রেজিস্ট্রার অফিসটি প্রায় ২০ লাখ টাকার দিয়ে সংস্কার করেন। আর এই সংস্কারের টাকা নেওয়া হয় জেলা ও ৮ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে।
শুধু তাই নয়, জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের সামনের জায়গা সাইকেল স্ট্যান্ডের নামে বরাদ্দ দেন। যেখান থেকে প্রতি মাসে অন্তত; ৫ লাখ টাকা উপরি আয়ের ব্যবস্থা করেন।
জেলা রেজিস্ট্রার আবু তালেব নিয়মিত অফিস করেন না। তিনি সোমবার যশোর আসেন বুধবার চলে যান। মাত্র তিনদিন অফিস করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। জেলা রেজিস্ট্রার আবু তালেব সপ্তাহের দুইদিন ঢাকায় বিমানে যাতায়াত করেন। একবার ঢাকায় বিমানে যেতে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা লাগে। সেখানে তিনি প্রতি মাসে আটবার ঢাকায় যাতায়ত করেন। অর্থাৎ প্রতি মাসে তার বিমান ভাড়া বাবদ ব্যয় হয় ৪০ হাজার টাকা। প্রতি মাসের অবৈধ উপার্জনের টাকা থেকে তিনি এই অর্থ ব্যয় করেন বলে অফিসের একাধিক সুত্র এতথ্য নিশ্চিত করেছেন। যশোর শহরে ৩০ হাজার টাকার দিয়ে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে রেখেছেন। যে কয়দিন তিনি অফিস করেন সেই কয়দিন তার ফ্ল্যাটে চলে রঙ্গলিলা। আর এই রঙ্গলিলার সকল আয়োজন করেন মোহরার শামসুজ্জামান মিলন।
সূত্র জানায়, যশোরের ৮ উপজেলা সাব রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে প্রতি মাসে চুক্তি মাফিক তিনি বড় অংকের উৎকোচ আদায় করে থাকেন। উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিস দলিল সম্পাদনা ও নকল থেকে এই ঘুষের টাকা নিয়ে থাকেন। যশোর জেলায় ১২২ জন কাজী রয়েছেন। যারা প্রতি মাসে অফিসের বড় বাবু সুতপা রায়ের মাধ্যমে জেলা রেজিস্ট্রারকে ঘুষ দিয়ে থাকেন।
সূত্র জানায়, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে এক সময় রেকর্ড কিপার ছিলেন ভৈরব চক্রবর্তী। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। যা তদন্ত কমিটি প্রমাণ পায়। তদন্ত কমিটির কাছে ঘুষ-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পর ভৈরব চক্রবর্তীকে জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। প্রায় দুই মাস সংযুক্ত থাকার পর ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে ভৈরব চক্রবর্তীকে স্বপদে বহাল করেন রেজিস্ট্রার আবু তালেব। রেকর্ড রুম থেকে প্রতি মাসে হাজার হাজার দলিলের নকল সরবরাহ করা হয়। এখাত থেকেও জেলা রেজিস্ট্রার নকল প্রতি মোটা অংকের উৎকোচ পেয়ে থাকেন। এছাড়া উপজেলা রেজিস্ট্রি অফিসগুলো অডিটের নামে প্রতি মাসে কোন না কোন অফিস থেকে মোটা অংকের উৎকোচ আদায় করে থাকেন। প্রতি মাসে জেলা রেজিস্ট্রারের অবৈধ উপার্জনের পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি।
এ ব্যাপারে জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুদক অভিযান চালিয়েছে। তারা কাগজপত্র দেখেছে। তবে দুর্নীতির তেমন কিছু পায়নি।