জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ওঠে। আর সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
সেই কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সেই কমিশন প্রণয়ন করবে জুলাই সনদ।
যার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে হবে সংবিধান সংস্কার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার। কিন্তু এটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হবে? কিংবা সবাই এই সনদে একমত হবে কি না। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সেটি বাস্তবায়ন করবে কি না, না করলে কী হবে? যেমন এরশাদ সরকারের পতনের পর তিন জোটের যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছিল তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
রাজনীতিবিদরা আশাবাদী, ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এটি রচিত হবে এবং বাস্তবায়িত হবে। তবে নির্বাচিত সরকার যদি এগুলোর বাস্তবায়ন না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জনগণ আন্দোলন করবে।
এসব প্রশ্নের মধ্যে ঐকমত্য কমিশন জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ সংস্কারের জন্যে গঠিত ছয়টি কমিশন প্রথমদিকে তাদের সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদনগুলো সরকারের কাছে জমা দেয়।
এই ছয়টি কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং পদক্ষেপ সুপারিশের উদ্দেশ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এই কমিশনের সভাপতি।
এ কমিশনে সহসভাপতি করা হয় অধ্যাপক আলী রীয়াজকে। অন্য সদস্যরা হলেন- ড. বদিউল আলম মজুমদার, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক এবং ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ কমিশনের মেয়াদ ছয় মাস।
জুলাই সনদ কেন এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম বৈঠকে আনুষ্ঠানিকতার পর কমিশন দল ও জোটগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করে সংস্কারের সুপারিশের ব্যাপারে মতামত নেয়। এখন দ্বিতীয় দফায় ঐকমত্যের জন্য বৈঠক চলছে। এরমধ্যে কয়েকটি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। আর দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সংস্কারের জন্য একটি ন্যাশনাল চার্টার বা জাতীয় সনদ তৈরি করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
নির্বাচনের আগে কোন কোন বিষয়ে ন্যূনতম সংস্কার করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা ঠিক করে বাস্তবায়ন করবে সরকার। আর দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কারের বিষয়গুলোও একইভাবে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হবে। নির্বাচিত সরকার এসে তা বাস্তবায়ন করবে। নির্বাচিত সরকার এলে সংস্কারের জায়গা থেকে যাতে সরে না যায়, সেজন্য সনদে সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকবে।
এসব বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে অধ্যাপক আলী রীয়াজের দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্য থেকে।
১৫ ফেব্রুয়ারি ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বৈঠক শেষে আলী রীয়াজ বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে যে বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—জাতীয় ঐক্য রক্ষার আর কোনো বিকল্প নেই। সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দলগুলো দৃঢ়তা প্রকাশ করেছে।
আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে; যেটা আজ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন— আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই, আমরা প্রত্যেকেই—রাজনৈতিক দল হিসেবে, নাগরিক হিসেবে, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই সংস্কারপ্রক্রিয়াকে সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তার লক্ষ্যেই আজ এই সূচনা।
ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দলগুলোকে বলেছিলেন, এই জিনিসটা করা হচ্ছে কারণ যাতে করে একটা সনদ তৈরি হয়। যেটা হবে জুলাই সনদ বা জুলাই চার্টার। এটিতে যেন আমরা সবাই মিলে একমত হতে পারি।
২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, এর লিখিত রূপ হিসেবে জাতীয় সনদের কথা বলা হচ্ছে। সেটা হচ্ছে সামাজিক চুক্তি। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সঙ্গে চুক্তি করবে। ফলে নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হবে, অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, রাষ্ট্র জবাবদিহির মধ্যে যাবে। এ জায়গা তৈরি করতে হবে।
১০ মার্চ জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দ্রুত রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের বিষয়ে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছাতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। পাশাপাশি স্বল্প সময়ের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছে জাতীয় সনদও তৈরি করতে চায় এই কমিশন।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে বাকি পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো ছক আকারে বিন্যস্ত করে সেগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর কাছে মতামত জানতে চেয়েছে জাতীয় ঐক্যমত কমিশন। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো তাদের মতামত দিলে সেটি নিয়ে আলোচনা করে স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করতে চাই।
আলী রীয়াজ আরো বলেন, গত ৬ মার্চ ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এতে মোট সুপারিশের সংখ্যা হচ্ছে ১৬৬টি। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি; নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ ২৭টি; বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি; জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সুপারিশ ২৬টি; এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সুপারিশ ২০টি। প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে।
সেগুলো হলো-‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়টি হলো প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এ ক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো- ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’ ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেওয়ার একটি জায়গা রাখা হয়েছে।
৮ এপ্রিল আলী রীয়াজ বলেন, স্বাধীনতা উত্তরকালে এই প্রথমবারের মতো আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণের একটা পথ পদ্ধতি তৈরি করেছি। এটা সম্ভব হয়েছে এই দেশের গণমানুষের সংগ্রামের কারণে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই সংলাপের মধ্য দিয়ে আমরা একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারব, যেখানে আমরা একটা জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারব। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৪ জুলাই পর্যন্ত।
তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জুলাই সনদ, যাতে আগামীর বাংলাদেশের একটি পথরেখা তৈরি হয়। এরই একটি অংশ হিসেবে নির্বাচন হবে। নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে জুলাই সনদের একটা বড় রকমের ভূমিকা থাকবে। জাতীয় সনদের একটা বড় রকমের ভূমিকা থাকবে, এটা আমরা আশা করি।
তিনি আরো বলেন, আমরা পথ খুঁজছি যাতে করে আমাদের লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথ আমরা সুনির্দিষ্ট করতে পারি। একত্রে অগ্রসর হতে পারি, ঐক্যের মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারি।
১৮ এপ্রিল অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেবল বারবার হোঁচট খেয়েছে তাই নয়; একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা। যাতে করে দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়।
২১ এপ্রিল আলী রীয়াজ বলেছেন, সংস্কার কমিশনগুলোর উদ্দেশ্য- বাংলাদেশে এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করা, যাতে করে পুনরায় কোনো অবস্থাতে ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে; যাতে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, জনগণ যেন বুঝতে পারে তাদের অধিকার সুরক্ষিত আছে। তার প্রেক্ষাপটে সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, গত ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছে, সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে। শুধু কাগজে আমরা কী লিখছি তা নয়, জনগণের প্রতি অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে এই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা। যার মাধ্যমে ক্ষমতার বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটে এবং বাংলাদেশ তার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে জাগ্রত হতে পারে।
অতীতের অভিজ্ঞতা
১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জারি করেন সামরিক শাসন। সেটি আশির দশকের পুরো সময় ধরে অব্যাহত থাকে। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট এবং বাম ঘরানার দলগুলোর সমন্বয়ে পাঁচ দলীয় জোট ‘তিন জোটের রূপরেখা’ঘোষণা করে। সেটি ছিলে সামরিক শাসক এরশাদের পদত্যাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘দালিলিক ভিত্তি’। এমনকি পরবর্তী রাষ্ট্রপরিচালনার দলিলও বটে।
সেই রূপরেখায় ছিল- ১. হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী এরশাদ ও তার সরকারের শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে:
ক. সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রেখে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী তথা সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদের (ক) ৩ ধারা এবং ৫৫ অনুচ্ছেদের (ক) ১ ধারা এবং ৫১ অনুচ্ছেদের ৩ নং ধারা অনুসারে এরশাদ ও তার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলনরত তিন জোটের নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে উপরাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
খ. এই পদ্ধতিতে উক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মূল দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।
২. ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হবেন অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা দলের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না। তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো মন্ত্রী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না।
খ. অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার শুধুমাত্র প্রশাসনের দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনাসহ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ও দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস করবেন।
গ. ভোটারগণ যাতে করে নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেই আস্থা পুন:স্থাপন এবং তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
ঘ. গণপ্রচার মাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং এই সংসদের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।
৪. ক. জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধানবহির্ভূত কোনো পন্থায়, কোনো অজুহাতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না।
খ. জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে।
গ. মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিল করা হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তর ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নির্বাচন ছাড়া বাকিগুলোর তেমন বাস্তবায়ন হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, জুলাই সনদের প্রয়োজনীয়তা কি আমাকে এটা জিজ্ঞেস করলে এখন আমি বলব, আমি জানি না। আগামী দিনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কি ভাবে চলবে তার একটা ঐকমত্যে আসা। এটাই তো হওয়ার কথা। আমাদের বক্তব্য যতটুকুতে ঐকমত্য হবে ততটুকু বাস্তবায়ন হবে। যেটা একমত হবে না সেটা নির্বাচিত সরকার পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেবে। এই সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। আগামীতে যে সরকার নির্বাচিত হয়ে আসবে, সেই সরকার বাস্তবায়ন করবে। সরকার যদি না করে আমরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবো। আমরা যদি ক্ষমতায় আসি এবং আমরা যদি বাস্তবায়ন না করি অন্যরা আমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করবে।
তিনি বলেন, ৯০ দশকে রাজনৈতিক দলগুলো একটা সমঝোতায় এসেছিল। যেটা ছিল তিন জোটের রূপরেখা। সেটাও এক ধরনের সনদ বলা যেতে পারে। এখন এইটা মানা না মানা নির্ভর করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর। সরকার না মানলে জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, জনগণ তখন সিদ্ধান্ত নেবে।
জুলাই সনদে সবাই সই করবে?
১৮ জুন কমিশনের এক বৈঠক শেষে সাংবিধানিক কাউন্সিল নিয়ে এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেন, যারা বিরোধিতা করছেন তারা যেন অবশই একটা বিকল্প প্রস্তবানা দেন। না হলে গণঅভ্যুত্থান, সংষ্কার প্রস্তাবনা, সেইগুলো ব্যর্থ হবে। কারণ আমরা আগের একটা সিস্টেম, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর। সেগুলো আগের নিয়মে চলবে এ ধরণের শঙ্কা, সংশয় তৈরি হয়েছে।
যে বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্য হবে না, সে বিষয়ে গণভোট চায় জামায়াতে ইসলামী। সে বিষয়ে এনসিপির অবস্থান নিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা গণপরিষদের কথা বলেছি। এখনো সেই অবস্থানে আছি। কারণ এই জুলাই সনদ, মৌলিক সংস্কার, ঐকমত্য আসলে কিভাবে বাস্তবায়িত হবে সেটি সিদ্ধান্ত হয়নি। কমিশন থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে সবার পরে আলোচনা হবে। আমরা দেখবো কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে, সংস্কারের দলিলটা কেমন হচ্ছে। মৌলিক সংস্কার হলে আমরা এ দলিলকে সমর্থন করবো বা এ প্রক্রিয়ায় যাবো। যদি মৌলিক বিষয় ছাড়া গুরুত্বহীন বিষয়ে ঐকমত্য হয়, তাহলে সেটা আমাদের শাসন কাঠামোর পরিবতন হবে না, সেটাকে আমরা মৌলিক সংস্কার হিসেবে বিবেচনা করবো না, তখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ঐকমত্য বলতে যদি শতভাগ বোঝায়, তাহলে এটা অসম্ভব। কারণ ৩০টা দল আছে। ঐকমত্যের ব্যাপারটি কনসাইজলি কনসেপ্ট তৈরি করতে হবে। যেখানে যেখানে বিতর্ক থাকবে সেখানে নোটসহ গণভোটের জন্য দিতে বলেছি। জনগণই এটার ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেক।
সব বিষয়ে যদি একমত না হওয়া দলগুলো যদি সরকার গঠন করে তাহলে এই সনদ টিকবে কি টিকবে না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরাতো আশা করি এখানে যে কমিটমেন্ট সবাই মিলে দিচ্ছি, জুলাই চার্টার হবে আমরা সেখানে সই করবো। যারাই ক্ষমতায় যাবেন, আমরা যাই বা অন্য কেউ যায়, আমরা এই কমিটমেন্ট রক্ষা করবো ইনশাআল্লাহ। সবারই কমিটমেন্ট রক্ষা করা উচিত।
আগেরদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, সন্তুষ্ট হবো কি হবো না সেটা আলোচনার পরে হবে। তবে আমরা চাই জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হোক। আমরা সবাই একটা জায়গায় আসি এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে নতুন গন্তব্য পৌঁছে সেই শক্তিশালী গণতন্ত্র বির্নিমাণ করি। সবাই যেন মিনিমাম জায়গায় এসে সংস্কারের বিষয় সমাপ্ত করতে পারি এবং জুলাইয়ের মধ্যে যেন জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয়।