আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নেওয়ার আলোচনা চলছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বাড়ছে আলোচনা-সমালোচনা। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি করলেও ঘোর বিরোধিতা করছে বিএনপি।
এ কারণে ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভিন্ন মত দিচ্ছে। ফলে ভোট নিয়ে এক ধরনের শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। কারণ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ মিত্ররা পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের প্রত্যাশাতীত সাফল্য ত্রয়োদশ নির্বাচনেও কাজে লাগাতে চায় দলটি।
দলটির নেতাকর্মীরা জুলাই সনদের ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ ৫ দফা দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছেন। এর মাধ্যমে জনমত তৈরি এবং ভোটের মাঠে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করেই তারা চেষ্টা চালাচ্ছে জোট বেঁধে ভোট করার।
এজন্য কয়েকটি ইসলামি দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতারও চেষ্টাও চলছে। কোনো অবস্থাতেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা। এজন্য রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি সমানতালে নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে নিতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কৌশলে পা ফেলছে জামায়াত। রাজপথে আন্দোলন তাদের নির্বাচনি কৌশলের অংশ। সরকার ও ‘বিশেষ’ একটি দলের ওপর চাপ রেখে ভোটের মাঠ সাজাচ্ছে জামায়াতের দায়িত্বশীলরা। ডাকসু-জাকসুর নির্বাচনে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দলটি কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনে ভালো করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না।
জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অন্তত ৫ জন নেতা জানান, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে কোনো শঙ্কা নেই তাদের। আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেতাকর্মীরা অটল। তারই ভিত্তিতে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্রার্থী নিজ নিজ এলাকায় প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। গণসংযোগ, মতবিনিময় সভা এবং উন্নয়ন ইস্যু নিয়ে জনগণের কাছে নিজেদের (প্রার্থী) তুলে ধরছেন। জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করছেন। তরুণ ভোটারদের টার্গেট করে অনলাইন ক্যাম্পেইনের প্রস্তুতিও চলছে জোরেশোরে।
জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষ নেতারা সবাই নির্বাচনি মাঠে বেশি সময় ব্যয় করছেন। ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন করলেও এটা নির্বাচনেরই কৌশলের অংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আমরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্যই এতকিছু করছি। আমাদের ইতিহাস কি? আমরা সংসদে ছিলাম। আবার রাজপথে মিছিল করেছি। সেই মিছিল থেকে আবার সংসদে গিয়েছি। এ কারণেই বলছি, রাজপথে আন্দোলন তো থাকবেই। কারণ জনগণ ও দেশের ইস্যু ছাড় দেওয়া যায় না।
সংস্কারের দাবি পুনর্ব্যাক্ত করে আমরা বলি সংস্কার চাই, সংস্কারের ভিত্তিতে সব হবে। সংস্কারের জন্য ৩ মাস সময় দিলাম, এটার কোনো লিগ্যালিটি নেই, বাস্তবায়ন নেই, তাহলে কি আমরা তামাশা করলাম? সংস্কার না হলে ইলেকশন কিসের ওপর হবে? পুরোনো আইনে তো নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। রাজপথে আন্দোলন করে দাবি আদায় না হলে নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা সময়ের ওপর নির্ভর করবে। জনগণ যা চাইবে সরকার তো তা-ই করবে। জনগণ না চাইলে কোনো কিছু তো সরকার চাপিয়ে দিতে পারবে না।
জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং দলটির কেন্দ্রীয় মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনে হবে এবং এই নির্বাচনের সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। রাজপথে আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বলেছি জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের দাবি হচ্ছে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে যেন নির্বাচনটা হয়। এখন তো আমরা ৫ দফা দাবিতে সমাবেশ দিয়েছি। আমরা আশা করছি জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন হবে।
দাবি আদায় না হলে জামায়াত নির্বাচনে যাবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অবস্থার আলোকে ও জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী যে কোনো সিদ্ধান্ত জামায়াত নিতে পারে।
জামায়াতের নির্বাচন বয়কটের কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, না। নির্বাচনের দাবি তো আমরাই করেছি, এবং ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন মূলত আমাদেরই দাবি। নির্বাচন বয়কটের তো প্রশ্নই ওঠে না। নির্বাচনই তো সমাধান। এটা ছাড়া দেশ চলবে কিভাবে। নির্বাচন নিয়ে আমরা সব প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে মনোনয়নও দিয়েছি। নির্বাচনি জোট গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এটা নিয়ে সময় লাগবে।
সূত্র বলছে, জোট গঠনের তোড়জোড় চালাচ্ছেন জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামী দলের শীর্ষ নেতারা। এক বাক্সে ভোট টানতে নির্বাচনি সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে আদৌ জোট গঠন হবে কিনা সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। এজন্য আরও কিছুটা সময় নিতে চায় দলগুলো। নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার আগে কোনো সমঝোতায় পৌঁছার লক্ষণ নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, তারা (জামায়াত) পিআরসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনের কথা বলছে। এর মানে তারা নির্বাচনে যাবেন না তেমন কিছু নয়। নির্বাচনের আগে একটা রাজনৈতিক আওয়াজ তুলছে। রাজনৈতিকভাবে ঠিকই আছে, তারা এটা করতেই পারে। দ্বিতীয় কথাটা হলো, এটার মাধ্যমে মানুষকে নতুন একটা পদ্ধতি (পিআর) সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করছে। আমার ধারণা তারা পিআর নিয়ে বুকলেট বের করবে এবং জনগণের মধ্যে এটা বিতরণ করবে।
তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে যদি জাতীয় নির্বাচন হয়, তাহলে এই নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আপনি যদি এটা (পিআর) করতে চান তাহলে আগামী নির্বাচনকে মাথায় রেখে করতে হবে। একই সঙ্গে আমার মনে হয়, জামায়াত আন্দোলন করলেও এই নির্বাচনে তারা অংশ নেবে।
এর আগে ১৫ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ৫ দফা দাবিতে ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। জামায়াতের দাবি হচ্ছে-জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করা; আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংসদের উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা; অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।