কলকাতায় বাংলাদেশ সংগ্রহশালা স্থাপন নিয়ে জটিলতা

ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে কলকাতার যে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের ভবন থেকে প্রবাসী সরকার পরিচালিত হয়েছিল, সেখানে সংগ্রহশালা গড়ার প্রস্তাব নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ভবনে সংগ্রহশালা তৈরীর প্রস্তাব দেন তাঁর সাম্প্রতিক ভারত সফরে – পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কাছে।

sri aurobindo bhavanকিন্তু ভবনটি অন্য কারণেও ঐতিহাসিক – সেটি ঋষি অরবিন্দের জন্মস্থান এবং তার পরিচালনার ভার আইন করে দেওয়া হয়েছে শ্রী অরবিন্দ সমিতি নামের একটি ট্রাস্টকে। তারা বলছে, ওই ভবন তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে ঋষি অরবিন্দের দেহাবশেষ রয়েছে। তাই সেই ভবন হস্তান্তর করতে তারা রাজী নয়।

কলকাতার চৌরঙ্গি এলাকায় ৮ নম্বর থিয়েটার রোড, যার বর্তমান নাম শেক্সপীয়ার সরণি, সেই ভবনটি থেকেই ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার, যা মুজিবনগর সরকার হিসাবে পরিচিত, সেটি পরিচালিত হত।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীই ওই বাড়িটি দিয়েছিলেন মুজিবনগর সরকারের ব্যবহারের জন্য।

সেখানে মুক্তিযুদ্ধের একটি সংগ্রহশালা তৈরীর পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। সম্প্রতি কলকাতা সফরে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি উত্থাপন করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কাছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক বলছিলেন, “প্রবাসে থেকে ভারতের সহযোগিতায় সরকার গঠন করে, সেটি পরিচালনার জন্য ভারত যা যা সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল – সব কিছুর সমন্বয় সাধন করা হত ওই ভবন থেকেই। তাই সেখানে একটি সংগ্রহশালা গড়তে চাচ্ছি, যেখানে সেই সময়কার নানা স্মৃতিচিহ্ন, নথি এসব থাকবে। একটা গবেষণাগারও রাখার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এই প্রস্তাবই প্রধানমন্ত্রী দিয়ে এসেছেন মমতা ব্যানার্জীকে।”

ওই বাড়িটি আবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা অরবিন্দ ঘোষ, যিনি পরে আধাত্ম্যজীবনে ঋষি অরবিন্দ, তাঁর জন্মস্থান। সেখানে রয়েছে ঋষি অরবিন্দের দেহাবশেষ। তাই অরবিন্দ ভক্তদের কাছে এই বাড়িটির গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর যখন মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা ৮ নম্বর থিয়েটার রোড ছেড়ে চলে যান, তার পরের বছর ভারত সরকার একটি বিশেষ আইন পাশ করে সেটিকে তুলে দিয়েছিল শ্রী অরবিন্দ সমিতি ট্রাস্টের হাতে।

তারা বহু পুরনো নথি ঘেঁটে বার করেছিল যে ওই ভবনেই জন্মেছিলেন ঋষি অরবিন্দ।

ওই ট্রাস্টের অন্যতম কর্মকর্তা ও কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সুপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তাঁদের যথেষ্ট সম্মান রয়েছে, কিন্তু অরবিন্দের স্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িটি অন্য কাউকে ছেড়ে দিতে তারা নারাজ।

“বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে তাঁরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন শ্রী অরবিন্দ। তিনি নিজে যেমন বারবার এই বাড়ির কথা বলেছেন, তেমনই আমরা বহু পুরণো নথি ঘেঁটে তার প্রমাণও পেয়েছি। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার একটি বিশেষ আইন তৈরী করে আমাদের সমিতির হাতে ভবনটি তুলে দেন। পন্ডিচেরী থেকে ৭৩ সালে সেখানে আনা হয় শ্রী অরবিন্দের দেহাবশেষ। সেই বাড়ি কী করে অন্য কোনও কাজে দিয়ে দেওয়া যাবে। আইনত সেটা করা যায় না,” বলছিলেন অধ্যাপক ভট্টাচার্য।

তিনি আরও জানাচ্ছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি ফিরে দেখতে সেদেশ থেকে অনেকেই আসেন ওই ভবনে, তাঁদের সকলকেই স্বাগতও জানানো হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ বিষয়ক বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানেরও অনুমতি দিয়েছেন তাঁরা। একটি স্থায়ী প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করছে শ্রী অরবিন্দ সমিতি, যেখানে ঋষি অরবিন্দের জীবন নিয়ে নানা তথ্য ও নিদর্শনের সঙ্গেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ওই ভবনের ভূমিকার উল্লেখও থাকবে। লাগানো যেতে পারে একটি ফলকও, কিন্তু ভবনটির ব্যবস্থাপনা বা কর্তৃত্ব তাঁরা অন্য কারও হাতে দিতে পারবেন না।

শ্রী অরবিন্দ সমিতির এই আপত্তির কথা জেনে মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলছিলেন, “এটা আমার জানা নেই যে ওই বাড়িতে শ্রী অরবিন্দের জন্মস্থান কী না। তা যদি হয়, তাহলে তাঁদের অধিকার তো আছেই। এটা আমরা সম্পূর্ণভাবেই ভারত সরকার আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ওপরে ছেড়ে দিচ্ছি। তারা যেমন সমাধান করবে, তেমনই মানতে হবে।”

ওই বাড়িটি থেকে কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হত, তা অনেকেরই মনে রয়েছে এখনও। সেই সময়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাঁকে নিয়মিত খবর সংগ্রহের জন্য যেতে হত ৮ নম্বর বাড়িতে।

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে কয়েক বছর আগে ঘুরে দেখেছিলাম ৮ নম্বর বাড়ির নানা কক্ষ।

“বাড়িটির বাইরে বি এস এফ পাহারা দিত। আর সঙ্গে থাকত মুজিবনগর সরকারের নিজস্ব বাহিনী। বাড়িটির উল্টোদিকে একটি বিখ্যাত হোটেল আছে। সেখানে পাকিস্তান গোয়েন্দা পাঠিয়ে ছবি তুলিয়েছিল। সেটা ছাপা হয়েছিল সেদেশের কাগজে, লেখা হয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে কোনও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না। এই ছবিই প্রমাণ করে যে কলকাতা শহরে একটি বাড়িতে বি এস এফের পাহারায় বসে কিছু ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধর কথা বলছেন,” স্মৃতি থেকে বিবিসি কে বলেছিলেন সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত।

তিনি আরও দেখিয়েছিলেন যে কোন ঘরে বসতেন প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, সেনা অধিনায়ক কর্ণেল ওসমানি সহ শীর্ষ নেতৃত্বর অনেকেই।

“তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেব এখানে বসতেন না। তাঁর দপ্তর ছিল ক্যামাক স্ট্রীটের অন্য একটি বাড়িতে। আর এই ৮ নম্বর বাড়ির নীচের তলায় একটা বড় ঘরে তাজউদ্দিন সাহেব বসতেন। তাঁর স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিন সহ বাকি পরিবার অবশ্য এখানে থাকতেন না। তাঁরা অন্য মন্ত্রীদের বাসস্থান ছিল যে সি আই টি রোডে, সেখানে থাকতেন। দোতলার বড় হলঘরটাতে দেখতাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেন নানা সেক্টর থেকে নির্দেশ নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধারা। দোতলার একটা ঘরেই কর্ণেল ওসমানি আর অর্থমন্ত্রী মনসুর আলি সাহেব বসতেন। পিছনের দিকের বড় বারান্দায় বসতেন কিছু অফিসার – যারা পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন। পরে অবশ্য যখন পাকিস্তানের যে উপদূতাবাস ছিল, তার কর্মকর্তারা যখন বিদ্রোহ করে বাংলাদেশে যোগ দিল সেই উপদূতাবাস ভবনে চলে গিয়েছিলেন সিভিল সার্ভিস অফিসারেরা। আর পিছনের বাগানে ছিল রান্নার জায়গা। সেখানেই একদিন দেখা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে,” বাড়িটিতে ঘুরতে ঘুরতে স্মৃতি রোমন্থন করেছিলেন সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত।

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তর মতো অনেকের স্মৃতিতে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলী থাকলেও তা যদি সংরক্ষণ না করা যায়, তাহলে অচিরেই হয়তো হারিয়ে যাবে বাংলাদেশ এবং ভারতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সময়।

আবার একই সঙ্গে ঋষি অরবিন্দের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্মস্থানও বদলানো যাবে না, সরানো যাবে না তাঁর দেহাবশেষ!

সকলেই আশায় আছেন, উপায় হয়তো কিছু একটা হবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা